আমি তো জোকার নই : চঞ্চল চৌধুরী
‘মনপুরা’, ‘মনের মানুষ’,-এর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রে শুধু নয়, নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রের বিভিন্ন চরিত্রেও অভিনয় করে দর্শকদের মন কেড়ে নিয়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। এরই মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন অমিতাভ রেজার ‘আয়না বাজি’ চলচ্চিত্রে। বর্তমানে খণ্ড ও ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে ব্যস্ত সময় পার করছেন জনপ্রিয় এই তারকা অভিনেতা। নাটক, চলচ্চিত্র, ব্যক্তিগত ও অন্য অনেক প্রসঙ্গে চঞ্চল চৌধুরী কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
প্রশ্ন : নিজের অভিনীত নাটকগুলো কি দেখার সময় পান?
উত্তর : এক ঘণ্টার নাটক ও বিশেষ দিবসের নাটকগুলো দেখি। ধারাবাহিক নাটকগুলো দেখা হয় না। যখন প্রচারিত হয় তখন অন্য নাটকের শুটিং সেটে থাকি।আগে নিজের অভিনীত নাটকগুলোর সিডি সংগ্রহ করে রাখতাম।এখন সিডি মার্কেটে আগের মতো নেই। সবাই ইউটিউবে ও মোবাইল ফোনে নাটক দেখে।ইউটিউবে বিশ্বের সবাই নাটক দেখতে পায়। এটা ভালো দিক। তাই সিডি এখন আর কেউ কিনছে না। আমরা সিডিতে আগের মতো নাটকও পাচ্ছি না।
প্রশ্ন : গ্রামীণ ও শহরের পটভূমির নাটকগুলোতে আপনার অভিনয় দর্শকনন্দিত হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে আপনি গ্রাম ও শহর কোন চরিত্রে অভিনয় করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
উত্তর : আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশটাই তো একটা গ্রাম। সবার শেকড় কিন্তু গ্রামে। পর্দার যে সংস্কৃতি সেটা নকল। কারণ আমাদের দেশে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক গল্প আছে যা আমরা পর্দায় নিয়ে আসি না। গ্রাম ও শহর দুই ধরনের চরিত্রেই কাজ করতে আমার ভালো লাগে। আমি চরিত্রকে বেশি প্রাধন্য দেই। তবে গ্রামের প্রতি আলাদা আকর্ষণ সবসময় কাজ করে। আমি স্কুল পর্যন্ত গ্রামে বড় হয়েছি। এখন অবশ্য গ্রাম আর গ্রাম নেই। গ্রামেও ডিশ সংস্কৃতি ঢুকে গেছে। গ্রামেও এখন পেট্রলবোমাবাজি হয়। তাই শহর ও গ্রামের আলাদা সংজ্ঞা দেওয়া খুব কঠিন।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও আপনি সফল হয়েছেন। তাহলে চলচ্চিত্রে অনিয়মিত হওয়ার কারণ কী?
উত্তর : আমি যে ধরনের চলচ্চিত্রে কাজ করতে চাই সে ধরনের কাজ খুব কম হয়। তা না হলে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হতে পারতাম। ‘মনপুরা’ করার পর ১০০/১৫০ চলচ্চিত্রে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছি। কলকাতা থেকেও প্রস্তাব অনেক এসেছে।কিন্তু আমি করিনি। কারণ ওই কাজগুলো করলে আমি জীবিত থেকেও মৃত হতাম। আমি সব সময় জোর দিয়েছি গল্প ও কাজের মানের ওপর। ধরেন আমি এক জায়গায় দাওয়াত খেতে গেলাম। সেখানে অনেক খাবার রাখা আছে। আমার যা পছন্দ হবে আমি সেটাই খাব। আমাকে জোড় করে কেউ তো খাওয়াতে পারবে না। কেউ বলতেও পারবে না, আপনি ওটা খাননি কেন? নাটক বেশি করছি। চলচ্চিত্রে বুঝে শুনে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি।
প্রশ্ন : অভিনয়কে আপনি কিভাবে দেখেন?
উত্তর : অভিনয়টাকে আমি আরধ্য মনে করি। আমি চারুকলায় পড়াশোনা করেছি, গান-বাজনা করি, অভিনয় করি। সৃজনশীল কাজ। সৃজনশীলকাজ যারা করে তাদের তো একটা দর্শন থাকতেই হয়। এটা চালাকির কোন দর্শন নয়।আমি নাটক ও ছবি অর্থের জন্য করি না। কাজ করে আমার জীবন ধারণ করতে হবে এটা আলাদা জিনিস। বেশি অর্থের জন্য অনেক অনেক কাজ করতে হবে এটা আমি চাই না। আমি কাজের মান দেখি। অভিনয় করলাম কিন্তু দর্শক পছন্দ করল না। এটাও আলাদা বিষয়। কিন্তু আমার ভেতর থেকে যেন ঘাটতি না থাকে। এখন যে কাজগুলো হয় সেগুলোতে দর্শন খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। নাটকে হাসি-কান্না, দেশ, শিল্প সবকিছু থাকতে হবে। আমি তো জোকার নই। দর্শককে হাসাতে আমি বাধ্য নই। দর্শক অনেক শ্রেণীর আছে। এমন নাটক হতে হবে যা বেশির ভাগ দর্শক দেখবে এবং সেখানে থেকে শক্তিশালী শিক্ষনীয় কোন বার্তা তারা নেবে।
প্রশ্ন : ভালো গান গেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন। মিশ্র অ্যালবামে গান করলেও নিজস্ব অ্যালবাম বের করেননি কেন?
উত্তর : আমি গানটাকে আলাদাভাবে কখনো দেখিনি। প্রত্যেক মানুষের গলাতেই বিধাতা সুর দিয়েছেন। মানুষ এটাকে কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা তার ব্যাপার। সুর সৃষ্টিকর্তা না দিয়ে দিলে সম্ভব না। আমার গলায় সুর জন্মগত ভাবে ছিল। নাটক ও ছবির চরিত্রেও সুর, তাল, লয় আছে। যারা অভিনয় করে তারা সেটা জানে। আমি ভালো ছবি আঁকি। তাই বলে আমি চিত্রশিল্পী নই। একটু গান গাইতে পারি আমি নিজেকে শিল্পী দাবি করতে পারি না। আমি কোনো কাজে ভুল করি না। ব্যক্তিগত জীবনে ভুল থাকতে পারে। সেটা অন্য বিষয়। তাই গান করেও আমি ভুল কিছু করতে চাইনি। সবকিছু একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। আমি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আ্যালবাম বের করার। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত তা বের করিনি।
প্রশ্ন : বিদেশি চ্যানেলের দর্শক বাড়ছে দিন দিন। এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
উত্তর : আমি বিশ্বাস করি ভালো কাজ হলে দর্শক সেটা দেখবে। বিদেশি চ্যানেল দর্শক দেখতেই পারে। তারা কতটা ভালো করল সেটে ভেবে মাথা নষ্ট করলে তো হবে না। দর্শক কি ধরনের নাটক ও অনুষ্ঠান দেখবে, সেই গুণগত মানের কথা চিন্তা করে আমাদের অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। তাহলে বোঝা যাবে আমরা কতটা সফল। এটাই মুখ্য বিষয়। টিভি খুললে দুই-আড়াইশো চ্যানেল পাই আমরা। যার যখন যেটা খুশি সেটা সে দেখতে পারে। কিন্তু দর্শক কোন চ্যানেলকে বেশি প্রাধান্য দেবে, এটা তার আকষর্ণের ওপর নির্ভর করে। দর্শকের কাছে যে অনুষ্ঠানটা বেশি টানবে সেটাই সে দেখতে চাইবে। হোক সেটা বিদেশি অথবা দেশি চ্যানেল। আমরা যদি ভালো অনুষ্ঠান দিয়ে দর্শক ধরে রাখতে পারি তাহলে আমরা সফল। আর যদি না পারি তাহলে আমরা ব্যর্থ। পুরোপুরি আমাদের ব্যর্থও বলা যাবে না। কারণ এখনো দর্শক আমাদের কাজ দেখছে। রাস্তাঘাটে বের হলে তারা অটোগ্রাফ নেয়, ছবি তোলে, অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। তারা যদি আমাদের কাজ একেবারেই না দেখত তাহলে এ রকম করত না। তবে এটা বলতে পারি আগের চেয়ে দর্শক অনেক কমেছে।
প্রশ্ন : দর্শক কমার মূল কারণ কী? আপনার কী অভিমত?
উত্তর : নাটকের গুণগত মান এখন অনেক কম। যাদের মধ্যে পেশাদারত্ব নেই তারা এই জায়গাটাতে কাজ করতে শুরু করেছে। পরিচালক হওয়ার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা প্রয়োজন সেটা অর্জন না করেই শুধু ক্যামেরাম্যান দিয়ে নাটক নির্মাণ করছে অনেক অদক্ষ পরিচালক। আবার ভালো মানের গল্প ও চিত্রনাট্যও নেই। এখন রচনা ও পরিচালনা একজনই করছেন। রচনা এত সহজ কাজ নয়। একদিন স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তো অভিনেতা হতে পারবে না। অনেক অভিনেতা ও অভিনেত্রী আছেন যাঁরা কোনো কিছু না শিখে কাজ করেন। এমনও আছেন যাঁরা পরিচালনা, অভিনয়ের বাইরের পেশায় আছেন তাঁরাও মন চাইলেই মিডিয়ায় কাজ করতে আসছেন। এই ধরনের লোকদেরও আমরা অনেক নাটকে দেখতে পাই। আমি এই ধরনের মানসিকতার লোকদের সঙ্গে কাজ কখনো করি না। কিন্তু অন্যরা তো ঠিকই করছে। জায়গাগুলো এভাবে নষ্ট হচ্ছে। অভিনয়ই আমার পেশা। মাসে আমার নির্দিষ্ট কিছু কাজ করতেই হয়। তাই আমিও অনেক সময় এসব বুঝে চুপ করে থাকি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? তবে এখনো ভালো নাটক নির্মিত হয়। আমাদের দেশে খণ্ড নাটক ও টেলিফিল্মের চাহিদা এখনো ফুরায়নি।
প্রশ্ন : চিত্রনাট্য ছাড়া নাটকগুলো কিভাবে নির্মাণ হচ্ছে?
উত্তর : কিছু মেধাবী পরিচালক আছেন যাঁরা চিত্রনাট্য ছাড়া কাজ করতে সক্ষম। তাঁরা নাটকের সেটে এসে অভিনেতার মুখে মুখে সবকিছু বলে বোঝাতে পারেন। কিন্তু সবার পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়। আমি কিছু নাটকে দেখেছি পরিচালক সেটে বসে চিত্রনাট্য লিখছেন। সেটা তো তিনি আগে থেকেই করে রাখতে পারেন। তাহলে কাজটা আরো অনেক ভালো হয়। আবার অনেকে সেটে লিখতে গিয়ে তাল সামলাতে পারেন না। আমি দুই-একটা নাটক চিত্রনাট্য ছাড়া করেছি। এরপর চিত্রনাট্য ছাড়া কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি।