রজনীকান্তের উত্থান
‘কাবালি, ডা’!
বয়সের কথা ভুলে যান। আশপাশে তাঁর কাছেপিঠের বয়সের যত রথী-মহারথী ছিলেন, তাঁদের কেউ বা এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রৌঢ় চরিত্রে কিংবা সামান্য উপস্থিতিতে পর্দায় হাজির হন। কেউ রয়েছেন বিশ্রামে, কেউ ত্যাগ করেছেন পৃথিবীর মায়া। তবে শিবাজি রাও গায়কোয়াড়ের কথা কারো সঙ্গেই যে মিলবে না! ১৯৭৫ থেকে ২০১৬—এখনো তাঁর হাঁকডাক আগের মতোই, উপস্থিতি তো নায়কের চেয়েও উচ্চে। বহু আগেই সুপারস্টার থেকে দেবতা হয়ে ওঠা এই মানুষটিকে আমরা সবাই চিনি রজনীকান্ত নামে। তাঁর নতুন ছবি ‘কাবালি’র রেকর্ড আসলে শেষটায় কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা হয়তো তিনি নিজেও বলতে পারবেন না।
দক্ষিণ ভারতে রজনীকান্তের খ্যাতির হিসাব অন্য পর্যায়ে। সেখানে তাঁর ছবিতে রীতিমতো মালা পরিয়ে দেন তারকারা, করে তোলেন দেবতুল্য। নিজের অস্তিত্ব ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে উঠলেও (সুপারস্টার হওয়ার আবশ্যক শর্ত), তাতে কখনোই নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি রজনীকান্ত। এ জন্যই হয়তো ভারতীয় ছবির প্রথম সুপারস্টার রাজেশ খান্নার সঙ্গে রজনীকে মেলালে শেষটায় রাজেশ খান্নার জন্য একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই।
রজনীকান্তের বাবা ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল। ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর বেঙ্গালুরুতে জন্ম রজনীর, তবে মূলত তাঁরা ছিলেন মহারাষ্ট্র অঞ্চলের। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মাকে হারান তিনি। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই খেয়েপরে বাঁচার জন্য সব ধরনের কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। তরুণ বয়সে কর্ণাটক ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনে বাস কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রতিভা ছিল জন্মগত ও সহজাত, এ সময়েই বাসে যাত্রীদের নিজের বিভিন্ন পারফরম্যান্সে মুগ্ধ করতেন তিনি। সেখান থেকেই অভিনেতা হওয়ার পরামর্শ পেয়েছিলেন। কানাড়ার যাত্রাপালায় অভিনয় করার সুযোগ পান। সেখানে তিনি ‘মহাভারত’-এর খলচরিত্র ‘দুর্যোধন’ হিসেবে অভিনয় করেছেন বহুদিন।
যেকোনো বড় প্রাপ্তির পেছনে অন্তত একটু সুযোগ না মিললে চলে না। সেটুকু সহায়তা কাজে লাগাতে পারা বিশাল ব্যাপার। শিবাজি রাও তখনো ‘রজনীকান্ত’ হয়ে ওঠেননি। এক বন্ধুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে মাদ্রাজ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন। এ সময়েই একটি মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের সময় নজরে পড়ে যান প্রখ্যাত পরিচালক কে বালাচন্দরের। এই পরিচালক তাঁকে তামিল ভাষা শিখতে বলেন। এর পর তিনি ১৯৭৫ সালের ছবি ‘অপূর্ভা রাগাংগাল’-এ তাঁকে কাস্ট করেন। এই ছবিতে এক ক্যানসারাক্রান্ত রোগীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রজনী। ছবিতে তাঁর চরিত্র বিশেষ লম্বা-চওড়া ছিল না বটে, তবে ছবিটি সে বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এই তো শুরু। এর পর নায়ক নয়, খলনায়ক চরিত্রে ‘আভরগাল’ আর ‘মুনদ্রু মুদিচ্চু’ ছবিতে অভিনয় করে বেশ ভালোভাবেই ক্যারিয়ারে থিতু হওয়ার আভাস দেন তিনি। এরপর লিড রোলে ১৯৭৭ সালের তামিল ছবি ‘চিলাকাম্মা চেপ্পিনিদি’তে অভিনয় করলেন। দাপটের শুরু তখন থেকেই, যা আজকের ‘কাবালি, ডা’ সংলাপ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
সত্তরের দশকে তামিল ছবির সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাদের একজন হয়ে ওঠেন তিনি। তার পর হঠাৎ করেই খানিকটা বিরতি নেন। তবে ফিরতে বেশি দেরি করেননি। অমিতাভ বচ্চনের সুপারহিট ছবি ‘ডন’-এর রিমেক ‘বিল্লা’ (১৯৮০) দিয়ে ফিরে আসেন পুরোনো প্রতাপ নিয়ে। ব্লকবাস্টার হিটের তকমা মেলে ছবিটির। তার পর ‘নেত্রিকান’ ও ‘মুরাত্তু কালাই’ দিয়ে ক্যারিয়ারে আবারও সাফল্য। ১৯৮৩ সালে বলিউডেও কাজ শুরু করলেন ‘আন্ধা কানুন’ ছবির মাধ্যমে, সঙ্গে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন ও হেমা মালিনী। অমিতাভ বচ্চন ও হেমার সঙ্গে পরের আবারও কাজ করেছেন তিনি, অমিতাভের সঙ্গে ‘হাম’ এবং হেমার সঙ্গে ‘চালবাজ’।
তামিল, কানাড়া, তেলেগু, মালায়লাম, হিন্দি, বাংলা, এমনকি ইংরেজি ভাষার ছবিতেও কাজ করেছেন রজনীকান্ত। ১৯৮৮ সালে ‘ব্লাডস্টোন’ নামে একটি হলিউডি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন, তবে সেটি সাফল্যের দেখা পায়নি। মজার বিষয় হচ্ছে, নিজের মাতৃভাষা মারাঠিতেই কোনো কাজ করা হয়নি তাঁর!
২০০৭ সালের ব্লকবাস্টার ছবি ‘শিবাজি’ রজনীকে এনে দেয় এশিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া অভিনেতার আসন, প্রথম স্থানটি জ্যাকি চ্যানের দখলে তখন। বহু বছর ধরেই বড়পর্দার কাহিনীতে রজনীর কখনোই মৃত্যু হয় না, কারণ এমন ‘ঘটনা’ ঘটলে বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিতে পারেন রজনীকান্তের ভক্তরা; এই আশঙ্কা থাকে নির্মাতাদের।
‘কাবালি’ নিয়ে এখন চলছে অন্য রকম উন্মাদনা। চিরাচরিত রজনীকান্তের যে স্টাইল বা অ্যাকশন, যা নিয়ে অনেকে দেদার হাসিঠাট্টাও করেন, তেমনটি নেই এই ছবিতে। এক প্রৌঢ় ব্যক্তির চরিত্রেই অভিনয় করেছেন রজনীকান্ত, চেহারা স্পোর্টিং হলেও বয়স্ক তো বটেই। তাতে কী, হাঁকডাক নিয়ে হাজির হয়েছেন নতুন আঙ্গিকে। ছবির দর্শক আর আয় কত হবে, তা নিয়ে আন্দাজ করারও সুযোগ থাকছে না, কারণ আরো সপ্তাহখানেক সব হলেরই সিট অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় তো বক্স-অফিসের গ্রস আর নেট ইনকামের হিসাব আন্দাজ করা ভার।
তবে একটা প্রশ্ন মাথায় আসে। ‘কাবালি’ ছবির ট্রেইলারে রজনীর একটি মনোলোগের মতো থাকে, যেটি দর্শকের আগ্রহ তুমুলে নিয়ে গেছে। সেখানে তিনি তথা ‘কাবালি’-কে নিজের পরিচয় এমনভাবেই তুলে ধরতে দেখা যায় যে, আর দশজনের মতো ভাবলে ভুল হবে, আমি হচ্ছি পুরোই আমার মতো! তখনই তার হুঙ্কার—‘কাবালি, ডা’! সেই আওয়াজে মোহগ্রস্ত দুনিয়াজোড়া ভক্ত। খাঁটি সুপারস্টারের পুরো অথেনটিক স্টাইল বুঝি একেই বলে। আর কারো ক্ষেত্রে বা আর কারো কি এই পর্যায়ে পৌঁছানো কখনো সম্ভব হবে? তখনই আসে প্রশ্নটা। রাজেশ খান্না দিয়ে শুরু, রজনীকান্তেই কি সমাপ্তি?
রজনীকান্তই কি ভারতীয় ছবির শেষ সুপারস্টার?