মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে শাহিন সামাদ
‘তখন সারা দেশে রেড অ্যালার্ট। হানাদাররা যাকে পায় তাকেই গুলি করে। মধ্যরাতে হঠাৎ গুলির শব্দে জেগে উঠি। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি হানাদারদের গাড়ির বহর। একপর্যায়ে লাইনে দাঁড়ানো কিছু লোক দেখতে পাই। কৌতূহল নিয়ে কিছুটা সময় অতিক্রম করতেই দেখি হানাদারদের গুলিবর্ষণে একজন একজন করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরে কান্নার শব্দ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। ততক্ষণে আমার স্বামী জেগে যায়। কি জন্য কাঁদছি জানতে চাইলেও বলিনি তাঁকে। যেন তাঁর মনোবল কিছুতেই না ভাঙে। কারণ, ভোরেই আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করব। নানা রকম বাধা বিঘ্ন মাড়িয়ে বোরকা পরে গন্তব্যে পৌঁছাই। মনে মনে বলছিলাম, যাই হোক না কেন পৌঁছাতে আমাদের হবেই।’ এভাবেই ভয়ানক সেই দিনগুলোর কথা বলছিলেন সুরযোদ্ধা শাহিন সামাদ।
মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্যরা ১৯৭১ সালে গান নিয়ে শাহিন সামাদ ঘুরে বেরিয়েছিলেন মাইলের পর মাইল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গাওয়া গান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেরণা জুগিয়েছে। শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করেছিলেন গানের মাধ্যমে। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় ছিলেন শাহিন সামাদ, লুবনা মরিয়ম, তারেক আলী, মাহমুদুর রহমান বেণু, নায়লা খান ,স্বপন চৌধুরী, দেবব্রত চৌধুরী, দুলালচন্দ্র শীল, মোশাদ আলী প্রমুখ।
কণ্ঠই ছিল এই শিল্পীদের একমাত্র হাতিয়ার। মুক্তিসেনাদের মানসিক শক্তি জোগাতে এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে ছুটেছেন তাঁরা। গান গেয়ে তাঁরা উদ্দীপ্ত করেছেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র যোদ্ধাদের। পাশে থেকে লড়াইকে বেগবান করেছেন এ সুরযোদ্ধারা। তাঁদেরই একজন শাহীন সামাদ, এখনো প্রায়ই ফিরে যান সেই উত্তাল সময়ে। এনটিভি অনলাইনকে তিনি জানান তাঁর সেই অনন্য অভিজ্ঞতার কথা।
প্রশ্ন : যুদ্ধের সময় কিভাবে কাজ করতেন?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল অল্প, কিন্তু দেশকে স্বাধীন করার চিন্তা সবসময় মাথায় কাজ করত। সকালবেলায় নাস্তা করে বের হয়ে যেতাম। শিডিউল অনুসারে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। ভাঙা একটা ট্রাকে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গান করতাম আমরা। দিনের পর দিন নিজেদের নাওয়া-খাওয়া, পোশাক-আশাক কিংবা ঘুমানোর কোন ঠিক-ঠিকানা আমাদের ছিল না। এমনকি একবার টানা ১০ থেকে ১২ দিন কেবল শাক-ভাত খেয়ে কাটাতে হয়েছে।
প্রশ্ন : কী কী গান করতেন তখন?
উত্তর : ‘রূপান্তরের গান’ শিরোনামে সাজানো হয়েছিল মুক্তি ও সংগ্রামী চেতনার গানগুলো। এগুলোর মধ্যে ছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, ‘শিকল পরা ছল’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায়’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘ ওই পোহাইল তিমির রাতি’। অনেক রকম গণসঙ্গীত গাওয়া হলেও আমরা বেশি গাইতাম ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘মানুষ হ মানুষ হ’, ‘এসো মুক্তি রণের সাথী’ প্রভৃতি।
প্রশ্ন : শুধুই কি গান করেছেন?
উত্তর : আমরা মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্যরা কেবল গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ-উদ্দীপনাই জোগানোর পাশাপাশি , ভারত এবং বাংলাদেশের নানা প্রান্তে গান গেয়ে অর্থও সংগ্রহ করতাম। আমাদের দল নিয়ে দিল্লি-বহরমপুর-কল্যাণী-শান্তিনিকেতন-আসানসোল এরকম বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করে বেড়াতাম। অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট করা হতো, সেটি পড়ে শোনাতেন হাসান ইমাম। স্টেজ সাজাতেন মুস্তাফা মনোয়ার। এই অর্থ দিয়ে ওষুধপত্র, কাপড়-কম্বল, হাঁড়ি-পাতিলসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে এবং শরণার্থীদের মাঝে বিতরণ করেছি।
প্রশ্ন : এই প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা কী?
উত্তর : আমি চাই তরুণরা যেন সময়ের কাজটা সময়ে করে। আমাদের সময় দরকার ছিল যুদ্ধ করা আমরা যুদ্ধ করেছি। এখন যারা স্বাধীন দেশে বাস করছে তাদের প্রয়োজন এই দেশকে সমৃদ্ধ করা। এটা সম্ভব যদি আমরা পড়াশোনা আর সঠিক ইতিহাস জেনে দেশকে ভালোবাসি। ছাত্ররা যদি মন দিয়ে পড়াশোনাটা করে তাহলেই দেশ সমৃদ্ধ হবে।