কেউ বাঘ, কেউ হাতি সেজে ঘুরছে : মাসুদ সেজান
জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক ‘চলিতেছে সার্কাস’-এর শততম পর্ব প্রচার হতে যাচ্ছে আজ। দর্শকনন্দিত নাট্যকার ও নির্মাতা মাসুদ সেজানের এই নাটকটি বাংলা ভিশনে প্রচারিত হয় প্রতি রবি ও সোমবার রাত ৯টা ৫ মিনিটে। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে নিজের নাটক এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এই নির্মাতা।
এনটিভি অনলাইন : নাটকের নাম ‘চলিতেছে সার্কাস’ কেন?
মাসুদ সেজান : একসময় আমরা সার্কাস টিকেট কেটে দেখতাম। অসম্ভব রকমের সব ক্যারিকেচার, কিন্তু বিচিত্র আর সাবলীল ভঙ্গির পরিবেশনা। সংস্কৃতির এই ধারা এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। না পড়লেও সমস্যা নেই, এর বিবর্তিত একটি রূপ প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরে-বাইরে, পারস্পরিক সম্পর্কে সবখানেই যেন সার্কাসের সেই চরিত্রগুলোই দেখতে পাই। কেউ বাঘ সেজে ঘুরছে, কেউ হাতি সেজে, আবার কেউ জোকার সেজে সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। সহজ করে বললে সমাজের চলমান নানা অসঙ্গতি ও অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড নিয়ে এ নাটকের গল্প তৈরি হয়েছে। তাই গল্পের সঙ্গে মিল রেখেই নাম রাখা হয়েছে ‘চলিতেছে সার্কাস’।
এনটিভি অনলাইন : এই নাটকের মধ্যেদিয়ে আপনি যা বলতে চান, সেটা কি বলতে পারছেন?
মাসুদ সেজান : বলার চেষ্টা করছি, সবাই জানে সব সত্যি কথা সরাসরি বলা সম্ভব নয়। এতে দুই ধরনের সমস্য দেখা দেয়। নাটকের কোনো চরিত্র কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মিলে গেলে সেটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে রিঅ্যাক্ট করে বসেন। অন্যদিকে নাটকের শিল্পমান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কাজেই আমি এমন একটা ফর্ম বেছে নিয়েছি, যেখানে রূপক অর্থে সত্যগুলোই বলছি, কিন্তু নাটকের শিল্পমান বজায় রেখে। আমরা জানি স্যাটায়ার ফর্মটি শিল্পের একটি শক্তিশালী ধারা। এর একসুতা ডানে গেলে সেটা কমেডি হয়ে যায় আর এক সুতা বামদিকে গেলে সেটা সিরিয়াস হয়ে যায়। হাস্য-রসাত্মক ভঙ্গিতে দর্শক বিনোদনের মধ্যে দিয়ে যেটুকুই বুঝতে পারবেন, সেটাই আমার সার্থকতা।
এনটিভি অনলাইন : একজন নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে সমাজের কাছে আপনার দায়বদ্ধতা কী?
মাসুদ সেজান : একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে যে দায়বদ্ধতা থাকা উচিত, সে রকমই। ব্যক্তি থেকে একটি পরিবার গড়ে ওঠে, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে শুধু রাষ্ট্র নয়, প্রত্যেক নাগরিকের কিছু দায়িত্ব থাকে। আমার কাজের মধ্য দিয়ে সেই দায়িত্বটাই পালন করার চেষ্টা করছি।
এনটিভি অনলাইন : বর্তমানে নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী?
মাসুদ সেজান : এটা বলে শেষ করা যাবে না। সামগ্রিক অর্থেই আমরা একটি দুঃসময় পার করছি। এখানে ভালো কাজ আর খারাপ কাজের মূল্যায়নের জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চ্যানেল বাড়ছে কিন্তু নাটকের বাজেট দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। চ্যানেলের সঙ্গে প্রোডিউসারের, প্রোডিউসারের সঙ্গে পরিচালকের, পরিচালকের সঙ্গে অভিনয়শিল্পীর সমন্বয়হীনতার কারণেই একটি জটিল অবস্থা তৈরি হচ্ছে। এত কিছুর পরেও কিন্তু আমাদের এখানে প্রচুর ভালো কাজ হচ্ছে। এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এই শিল্পটাকে ভালোবাসেন বলেই—বলা যায় অর্থের না, মনের জোরেই কাজটাকে ভালো করার চেষ্টা করছেন। তবে এভাবেও তো আর সব সময়ের জন্য সম্ভব না, একসময় মন ভেঙে যেতে বাধ্য। সমন্বিত একটি উদ্যোগ নিয়ে, একটি আদর্শিক কাজের পরিবেশ তৈরি করা খুবই জরুরি।
এনটিভি অনলাইন : ভারতীয় সিরিয়ালের আদলে এখানেও নাটক নির্মাণ শুরু হয়েছে, এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাসুদ সেজান : মোটেই ভালোভাবে দেখছি না। আমি আগেও কিছু ইন্টারভিউতে, টেলিভিশনের লাইভ শোতে বলেছি, ওদের চেয়ে আমাদের নাটকের মান এক লক্ষ গুণ ভালো। ওদের হায়ার করে এনে, আমাদের চেয়ে তিনগুণ বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে, বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিয়ে সেটি প্রচারের ব্যবস্থা করার চেয়ে আমাদের দেশের যারা ভালো নির্মাতা আছেন, তাদের কিছুটা বাজেট বাড়িয়ে দিলেই আরো ভালো করা সম্ভব। আসলে ক্রাইসিসটা অন্যখানে হয়েছে, আমাদের মানসিকতায়। ওদের দিয়ে নাটক বানালে আমরা সেখানে বাজেট বাড়াতে পারছি, বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রচার করতে পারছি, তাহলে আমাদের দেশের নির্মাতাদের ক্ষেত্রে সেটা পারছি না কেন? দেশপ্রেমের অভাব, নাকি অন্য কোনো হিসাব-নিকাশ আছে সেটা আমার বোধগম্য নয়।
এনটিভি অনলাইন : ‘চলিতেছে সার্কাস’ নাটকটির আজ ১০০তম পর্ব প্রচারিত হচ্ছে, নাটকটিকে আর কতদূর নিতে চান?
মাসুদ সেজান : নাটকটির কেন্দ্রতে রয়েছে দর্শকের আগ্রহ ও ভালোবাসা। দেশে এবং দেশের বাইরে অসংখ্য দর্শক আছেন যাঁরা নাটকটির একটি পর্বও মিস করছেন না, গল্পের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি চরিত্র, এমনকি চরিত্রের সংলাপ পর্যন্ত তারা মুখস্থ শুনিয়ে দিচ্ছেন। এটি নিশ্চয় একটি ভালো লাগার ব্যাপার। শততম পর্বের কাছাকাছি এসে পৌঁছোতেই অনেকে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে আমাকে অনুরোধ করেছেন, নাটকটি যেন এখনই শেষ না করে দেই। কিন্তু আমি আমার ‘লং মার্চ’ ও ‘রেড সিগন্যাল’-এর ক্ষেত্রে যা করেছিলাম, সে রকমই কিছু একটা ভাবছি। আমি যে গল্পটা বলতে চাই, যেখানে গিয়ে মনে হবে আমি বলতে পেরেছি, সেখানেই শেষ করে দেব। টেনেহিঁচড়ে লম্বা করতে চাই না।