পর্দা নামছে জমজমাট নাট্যোৎসবের
জমজমাট আয়োজন ছিল এ উৎসবের প্রথম দিন থেকেই। আজ ৮ ডিসেম্বর শেষ দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল ‘দশম কেন্দ্রীয় বার্ষিক নাট্যোৎসব-২০১৫’।
উদ্বোধনী দিন সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হয়েছে মার্টিন শেরম্যানের নাটক ‘দ্য বেন্ট’। নাটকটি অনুবাদ ও নির্দেশনায় রয়েছেন শাহারুল ইসলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এই নাটকে রূপায়িত হয়েছে ইহুদিদের ওপর হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের দৃশ্য। নাটকের প্রথম দৃশ্যেই উন্মোচিত হয় তিনজন ইহুদি সমপ্রেমী কী করে নাৎসি বাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়। নাটকটিতে মূলত একদিকে জার্মানির নাৎসি বাহিনির সীমাহীন অত্যাচার, অন্যদিকে একদল সমপ্রেমী মানুষের অকৃত্রিম প্রেম স্থান পেয়েছে। নির্দেশক ছিলেন শাহারুল ইসলাম কাজল।
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন মঞ্চস্থ হলো আরো পাঁচটি নাটক। এর মধ্যে রয়েছে সাইমা ফারজানার নির্দেশনায় ‘কালের যাপনরঙ্গ’; নাজমুল হুদা সাকীর নির্দেশনায় ‘ডেথ নকস’; কামরুল ইসলামের রচনা ও নির্দেশনায় ‘ভস্ম’; সাওগাতুল ইসলাম হিমেলের নির্দেশনায় ‘৪.৪৮ সাইকোসিস’ এবং ইশতিয়াক খান পাঠানের নির্দেশনায় ‘ক্রেভ এন্ড নট ক্রেভ’ ।
‘কালের যাপনরঙ্গ’তে থিয়েটারের মুহূর্ত নির্মিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে কখনো কখনো বিদ্রূপ করার লক্ষ্যে দর্শকের সঙ্গে এক ধরনের বৈরিতার বাস্তবতা রূপায়িত হয়েছে। ‘ডেথ নকস’-এ প্রাত্যহিক বাস্তবতার সঙ্গে অনেক অনুরোধ-উপরোধ, ক্রীড়া-কৌশল করেও অ্যাকারম্যান মৃত্যুকে এড়াতে পারে না। হাসি ও শ্লেষের মেজাজে এই নাটক মানবজীবনকে পরিহাস করে।
মানবমনে আত্মদ্বন্দ্বের কোপানলে প্রতিমুহূর্ত যে বিচ্ছেদ ঘটে ‘ভস্ম’ নাটক তার প্রতিচ্ছবি মাত্র। প্রবাহিত জীবনে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীকালে সে লক্ষ্য পূরণের জন্য মানুষ যেভাবে তার জীবনচাকা চালনা করে, তাতে কার জীবনের কী দুমড়ে-মুচড়ে যায়, তার ভালো-মন্দ বিবেচনাহীন হয়ে পড়ে। এই নাটকে নারায়ণ চণ্ডালের জীবনে তাই প্রতীয়মান হয়।
‘৪.৪৮ সাইকোসিস’ উত্তরাধুনিক এই নাটককে ব্যথার মানবিক অভিজ্ঞতার ব্যবচ্ছেদরূপে একদিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে। নাট্যকার সারা কেইন নিজের তীব্র ডিপ্রেশনের সময়ে, ১৯৯৮/৯৯ সালের শরৎ ও শীতকালজুড়ে এটি লিখেছিলেন।
অন্যদিকে ইশতিয়াক খান পাঠানের নির্দেশনায় ‘ক্রেভ এন্ড নট ক্রেভ’ এই পারফরম্যান্সের মূল উৎস, ইংরেজ উত্তরাধুনিক নাট্যকার সারাহ কেইনের ক্রেভ নাটক। নাটকটি লেখিকার একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। ক্রেভ নাটকটি চারটি কণ্ঠস্বরে বিভক্ত। এদেরকে কেবল সি, এম, বি, এ—এই অক্ষরগুলো দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই চার কণ্ঠস্বর যেন একজন ব্যক্তির একই সঙ্গে ভেতর ও বাইরের জীবনেরই প্রতিধ্বনি। কিন্তু এই প্রযোজনা চারজন অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপস্থিতির মাধ্যমে দৃশ্যায়িত হয়েছে। চারটি পৃথক শরীর যেন একটাই জীবনের অধিকারী।
আজ উৎসবের সমাপনী দিনে প্রদর্শিত হবে ধীমান চন্দ্র বর্মণের নির্দেশনায় ‘ব্রাত্য’ নাটকটি। একাকিত্বে আবদ্ধ জীবন ইলিয়ার। দুটি পা তাকে পৃথিবীর সবকিছু থেকে আলাদা করেছে, বিচ্ছিন্ন করেছে, সংস্কারহীন করেছে। কারণ তার দুটো পা নেই। পচা কাঠের পা দুটো নিয়ে তার লড়াকু জীবন। পঙ্গুত্ব তাকে সবার কাছ থেকে করেছে ব্রাত্য, অভাজন, পতিত, আচারভ্রষ্ট। কিন্তু আন্তন নামের এক যুবক এসে ইলিয়ার সেই ব্রাত্য জীবনের বিচ্ছিন্নতা ঘুচিয়ে দেয়, বাঁচার অন্য এক আলো আসে ইলিয়ার ঘরে। যে-জীবন ব্রাত্য সে-জীবন স্বর্গীয় সম্পর্কের মহিমা লাভ করে। প্রেমে-কামে-প্রতারণায়, স্মৃতিতে-স্বপ্নে, ঘৃণায়-হতাশায়-বিতৃষ্ণায়, মাতালতায় আর বন্ধুত্বের নিবিড়তায় এই বাস্তবের সঙ্গে পরাবাস্তবের মিশেলে ব্রাত্যজীবনের অতলে চাপা পড়ে থাকা অন্য এক জীবনসত্যের মুখোমুখি করে। আজ সন্ধ্যা ৭টায় ‘ব্রাত্য’ প্রদর্শিত হবে টিএসসি মিলনায়তনে আর সেই সঙ্গে সমাপ্ত হবে উৎসব।