লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে: ইরফান খান
চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি খবর রটে যায় বিরল এক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলিউড তারকা ইরফান খান। এ সময় তাঁর রোগ নিয়ে নানা ধরনের গুজব রটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। অবশেষে নীরবতা ভেঙে ইরফান জানান, নিউরোএন্ডেক্রিন টিউমার বা জটিল ধরনের মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।
তারপর সবকিছু চুপচাপ হয়ে যায়। কেমন আছেন ইরফান? কেমন চলছে তাঁর চিকিৎসা? চিকিৎসায় আসলেই তাঁর কোন উন্নতি হচ্ছে তো? এ রকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিলেন না তাঁর ভক্তরা। ইরফানের সামাজিক মাধ্যমেও পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁর শারীরিক অবস্থার নতুন কোনো খবর।
তবে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন ইরফান খান। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে বর্তমান পরিস্থিতির খবর। বলেছেন তাঁর রোগের সাথে এখনো লড়ে যাওয়ার কাহিনী। নিজের রোগ সম্পর্কে ইরফান বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই আমি নিউরোএন্ডোক্রিন ক্যানসারে আক্রান্ত। শব্দটাই আমার কাছে একেবারে আনকোরা। রোগটাও বিরল। এতটাই বিরল যে এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতিও নেই। খানিকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতোই এগিয়েছে আমার চিকিৎসা।’
আকস্মিক এই রোগ সম্পর্কে ইরফান আরো বলেন, ‘অনির্দিষ্টতাই একমাত্র নির্দিষ্ট করা থাকে। বাকি কিছুই আমরা আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রাখতে পারি না। খুব দ্রুতগামী একটা ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। ছিল স্বপ্ন, একগাদা ভাবনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা। পরিকল্পনাও ছিল হাজারো। আর এই সবের মধ্যেই আমি বুঁদ হয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎই কে যেন পিছন থেকে ডাকতে লাগল। ঘুরে দেখি, এ যে টিকিট চেকার। বলছেন তোমার গন্তব্য চলে এসেছে। এবার যে নেমে যেতে হবে। আমি তো অবাক, হতভম্ব। বললাম, আমার গন্তব্য এখনো আসেনি। তিনিও নাছোড়বান্দা। আবারও বললেন, না এটাই তোমার গন্তব্য। এই আকস্মিকতা আমাকে একটা জিনিস পরিষ্কার করে দিয়েছিল। মানুষ নিতান্তই একটা কর্ক, অনিশ্চিত কিছু স্রোতের সঙ্গে ভেসে ভেসে যেতে হয়। আর মানুষ সর্বক্ষণ মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে ওই অযাচিত স্রোতকে নিজের কবজায় রাখার।’
হাসপাতালে প্রিয় মানুষদের আগমন আর রোগের ভয়াবহ যন্ত্রণা সম্পর্কে ইরফান বলেন, ‘ছেলে যখনই হাসপাতালে আসত, ওকে বারবার বলতাম যেন ঘাবড়ে না যাই! ভয় যেন আমাকে একঘরে করে না দেয়। আর ঠিক তার পরই সেই যন্ত্রণার না বলে কয়ে আগমন। এত দিন তো যন্ত্রণা বিষয়টা জানতাম। আর এখন পরিচয় হলো তার সঙ্গে। কাছ থেকে তাকে দেখলাম। জানতাম তার প্রকৃতি, তার ভয়াবহতা। কোনো সান্ত্বনা, কোনো প্রার্থনা— কিছুই সেইসময়ে কাজ করছিল না। ঈশ্বরের থেকেও যেন বড় হয়ে উঠছিল যন্ত্রণা।’
কয়েকদিন আগেই টুইটারে পাকিস্তানি এক সাংবাদিকের পোস্ট করা ছবি নিয়ে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটের দর্শকসারিতে খেলা উপভোগ করছেন ইরফান। টাইমস অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে আলাপকালে খেলা দেখার পাশাপাশি ওঠে হাসপাতাল প্রসঙ্গও। ইরফান বললেন ‘যন্ত্রণায় যখন কাহিল, লন্ডনের হাসপাতালে ছুটতে গলো অগত্যা। বুঝতে পারলাম ক্রিকেটের মক্কা লর্ডস স্টেডিয়ামের উল্টো দিকেই আমার হাসপাতালটা। যন্ত্রণার মাঝেই আবছা চোখে ভিভিয়ান রিচার্ডসের পোস্টারটা নজরে এলো। দেখি, আমার দিকে তাকিয়ে উনি হাসছেন। তবে হাসপাতালে আমার রুমটার বাইরে দাঁড়ালেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতো। মনে হতো, জীবন আর মৃত্যুর এই খেলার মাঝে শুধু একটাই রাস্তা চলে গিয়েছে। একদিকে হাসপাতাল, আরেকদিকে স্টেডিয়াম। হাসপাতালের এই অদ্ভুত লোকেশন আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সে সময়ে আমার কাছে নিশ্চিত ছিল শুধুই অনিশ্চয়তা। আমার এই খেলাটা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। হাসপাতাল নিয়ে আমার ওরকম ভাবনা আমাকে বাধ্য করেছিল পুরোদমে আত্মসমর্পণ করতে। সামনে কী আছে, ভবিতব্য কী, তা না জেনেই। চার মাস, আট মাস নাকি দুই বছরে সেরে উঠব তা-ও জানি না।’
প্রথমবারের মতো জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পেরেছেন জানিয়ে ইরফান আরো বলেন, ‘প্রথমবারের জন্য টের পেলাম স্বাধীনতা আসলে কী? আর এটাই আমার কাছে সবচাইতে বড় প্রাপ্তি। মনে হচ্ছিল জীবনের স্বাদ যেন আমি এই প্রথমবার চেখে দেখছি। জীবনকে চিনতেও পারলাম এই প্রথম।’
সাক্ষাৎকার শেষে ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ধন্যবাদ দিয়ে ইরফান জানিয়েছেন এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন তিনি। ইরফান বলেন, ‘আমার এই গোটা জার্নিটায় বহু মানুষ আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন। তাঁদের কেউ আমার চেনা, অনেকেই অচেনা। পৃথিবীর কোনো এক কোণে, কোনো এক প্রান্তে, যেখানে যাঁরা আমার জন্য প্রার্থনা করছিলেন, তাঁদের সবার প্রার্থনাই যেন আমার জন্য এক হয়ে গিয়েছিল। সব প্রার্থনা একাকার হয়ে একটা অন্যরকম শক্তির জোগান দিচ্ছিল আমাকে। সেই শক্তিই আমাকে বারবার বলছিল যে লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে।’