রুবাইয়াতের কাছে নারীরাই ‘হিরো’
‘মেহেরজান’ ও ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ছবির পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন নিউ ইয়র্ক ফিল্ম একাডেমি থেকে চলচ্চিত্র নির্মানের উপর ডিপ্লোমা করেছেন। রুবাইয়াত আমেরিকার স্মিথ কলেজ থেকে ওম্যান স্টাডিসে বিএ এবং পেনস্যালভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাউথ এশিয়ান স্টাডিসের উপর এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার আগ্রহের বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সুফিজম, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, বাঙ্গালী মর্ডানিটি ও ফিমেল সেক্সুয়ালিটি সহ নানা বিষয়। এখন তিনি কাজ করছেন নতুন ছবি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নিয়ে। সম্প্রতি রুবাইয়াত কথা বলেছেন পার্থ সনজয়ের সঙ্গে। রুবাইয়াতের আলাপ নিচে দেয়া হলো।
‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-একটা ব্র্যান্ড
আমি এই ছবিতে দেখাতে চেয়েছি, আসলে মেড ইন বাংলাদেশ যে উওম্যান, এটা একটা স্ট্রং ব্র্যান্ড অব উওম্যান। এটা আমি আগেও বলেছি সবসময়। রুমানা মনজুরের উদাহরণটা আমি সবসময় দেই। যে অন্ধ হয়ে যাবার পরও পিএইচডি শেষ করেছেন। বা জুঁই। গ্রামের যে সাধারণ মেয়েটির আঙ্গুল কেটে ফেলার পরও সে পরীক্ষা দিয়েছে। পাশ করেছে। এই যে একটা অদম্য ব্যাপার বাংলাদেশের নারীদের যেটা আমি গার্মেন্টসের নারীদের ভেতর দেখতে পাই। রাস্তায় যে ভাবে দলে দলে নারী হেঁটে যাচ্ছে, তাদের কন্ট্রিবিউশনেই আমাদের এই ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট। আমি এদেরকে হিরো হিসেবে দেখতে একটা ছবি করেছি।
নারীদের গল্পটা যখন নারীরা বলেন তখন তা আলাদা হয়
আমি তো সবসময় এটা বলি, যেহেতু আমার ব্যক্তিগত জীবন বা একাডেমিক লাইফে সবসময় জেন্ডার ইস্যুটাকে বুঝতে চেয়েছি। নারী পুরুষের যে সামাজিক অবস্থান, ক্ষমতার যে প্ল্যাটফর্ম তা তো আলাদা। তো সে জায়গা থেকে এই বিষয়গুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন একটা গল্প বলতে চাই, তখন ন্যাচারালি এই গল্পটাই বলতে চাই, যা বলা হয় নাই।
ঐতিহাসিকভাবে আপনি যদি দেখেন, বেশীরভাগ সময় পুরুষ নির্মাতারা নারীদের গল্প বলছেন।আমার মনে হয়েছে, এমন একটা সময় আমাদের নিজেদের গল্পটা আমাদেরই বলা উচিত।কারণ সবসময় আমরা আমাদের গল্পটা অন্যের মুখ থেকে শুনেছি।
আমি যখন ছোট ছিলাম, ‘সাতকাহন’ আমার প্রিয় একটা বই ছিল। দীপাবলী প্রিয় একটা চরিত্র।কিন্তু দীপাবলী ক্রিয়েট করেছে সমরেশ মজুমদার। তো ঐ রকম একটা ফিমেল রাইটার যখন একটা ফিমেল কারেক্টার নিয়ে লেখে বা ফিমেল ডিরেক্টর ঐ চরিত্রটা বানায়, আমার মনে হয় তা ডিফারেন্ট হয়।
আর অভিজ্ঞতাও একটা বড় ব্যাপার। যেমন একটা মেয়ের যে ধরণের অভিজ্ঞতা হয় জীবনে, একটা ছেলের কখনোই সে অভিজ্ঞতা হয় না। তাহলে কীভাবে সে নারীর শতভাগ গল্পটা লিখতে পারবে? আমি বলছি না, একজন নারী বলেই একটা গল্প সে শতভাগ ঠিকভাবে লিখতে পারবে। কিন্তু আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা পড়ি, তখন তার যে ভয়েসটা আমি শুনি, তার যে অভিজ্ঞতা এবং বেদনার কথা শুনি, সেই ভয়েসটা ইয়েটসের কোন মেয়েদের নিয়ে লেখা কবিতায় পাই না। হয়তো অ্যাকুরেট কিন্তু একইরকম না। আসলে আমি যখন রবীন্দ্রনাথ একটা মেয়ের জবানীতে লিখছেন, সেটা যখন পড়ি, এট দ্য সেইম টাইম, বিনোদিনী দাসীর ‘আমার কথা’ বইটা পড়ি, একটা কিছু পার্থক্য থাকে।
এটাতে আমি ইন্টারস্টেড। একই সঙ্গে আমি মনে করি, সত্যজিৎ রায় কিন্তু বেশ ভালোভাবে মেয়ে চরিত্রকে চিত্রায়ন করেছেন। তাই এটা লক্ষ্য না যে, শুধু নারীরাই নারীদের গল্প বলবে। বা পুরুষরাই পুরুষদের গল্প বলবে। ব্যাপারটা একদমই এরকম না। কিন্তু একই সাথে একটা অসামঞ্জস্য আছে। অন্তত সংখ্যার দিক থেকে। যতজন পুরুষ নারীর গল্পটা বলেছেন, ততজন নারী কিন্তু নারীর গল্পটা বলেননি।
দেখেন, সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা যদি দেখি, চারুর চরিত্রটা যদি দেখি বা বিমলার চরিত্রটা যদি দেখি-আমার কোন কমপ্লেইন নেই।আমি আমার নিজেকে ফিল করি ওখানে। কিন্তু সব পুরুষ নির্মাতার ছবিতে হয়তো করি না।
হেড অব ডিপার্টমেন্ট নারী!
মেড ইন বাংলাদেশের অনেকগুলো হেড অব ডিপার্টমেন্ট ছিলেন নারী। মেড ইন বাংলাদেশের একটা ছোট সিনোপসিসের ট্রিটমেন্ট ছিল। এটা নিয়ে আমি প্রোডিউসারের সাথে দেখা করি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।তারপর থেকে আমি কাজ করছিলাম এটা নিয়ে। ঐ বছরের আগস্টে লোকআর্নোতে গেলাম। ২০১৭ সালে গেলাম বার্লিনে স্ক্রিপ্ট ওয়ার্কশপে। তাপপর হংকং ফাইনান্সিং ফোরামে। এর মাঝেই স্ক্রিপ্টটাকে ওভার দ্য টাইম ডেভেলপ করছিলাম। সেই সাথে আমার প্রোডিইসারের সাথে প্রতিদিন কথা বলতাম। সমস্ত ফান্ডের জন্য আমার প্রোডিউসার এপ্লাই করেছে।
আমরা ফ্রান্স সরকার থেকে সিএনসি ফান্ড পেয়েছি। যা অনেক কম্পিটিটিভ। এটা আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। নরওয়ে সরকার থেকে পেয়েছি সোরফন্ড প্লাস, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে পেয়েছি ইউরিমাজ ফান্ড। আমাদের ছবির পোস্ট প্রোডাকশনটা হবে ড্যানিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। গেল বছর লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভালে ওপেন ডোরসে সেরা চিত্রনাট্যের জন্য আমরা পেয়েছিলাম ‘আর্টে ইন্টারন্যাশনাল’। সব মিলিয়ে আমরা দারুণ উৎসাহ পেয়েছিলাম। এছাড়া ছবিটির ওয়ার্ল্ড ডিস্ট্রিবিউটর ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় পরিবেশক পিরামিড ফিল্মস। এবছর এপ্রিলের ১৮ তারিখে আমরা কাজটা শুরু করেছি। টানা ৩৬ দিনে শেষ করেছি। ছবিটিতে পাঁচটা মেয়ে চরিত্র। এরা হলেন নভেরা রহমান, দ্বীপান্বিতা মার্টিন, পারভীন পারু, মায়া আর রিকিতা নন্দিনী। একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন মোস্তফা মনোয়ার।আছেন শতাব্দী ওয়াদুদ, মোমেনা চৌধুরী, শাহানা গোস্বামী, সামিনা লুৎফা, জয় রাজ।
মেড ইন বাংলাদেশের সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন স্যাবিন। ও ফরাসী। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট এলিশা অ্যালবার্টও ফরাসী। প্রোডাকশ ডিজাইন করেছেন কোলকাতার জোনাকী।