তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম দ্বিগুণ দেখতে পাই : শাহীন সামাদ
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে গান গেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া দেশের তিনি একজন স্বনামধন্য নজরুল সংগীতশিল্পী। আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে শরণার্থী ক্যাম্পে গান করার নানা স্মৃতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন শাহীন সামাদ।
এনটিভি অনলাইন : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আপনি দেশের বিজয় কীভাবে উপভোগ করেছিলেন?
শাহীন সামাদ : এখন প্রত্যেকবার বিজয় দিবস আসলে সেই দিনের কথা মনে পড়ে। আনন্দে কেঁদেছিলাম সেদিন। চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সবাই মিলে রাস্তায় বের হয়েছিলাম। চারদিকে ছিল হৈচৈ আর ফটকাবাজি। মাত্র নয় মাসের মধ্যে আমার স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই আনন্দের অনুভূতি ছিল অনেক মধুর। রোমাঞ্চকর। কম-বেশি সেদিন সব বাড়িতে মিষ্টি খাওয়া হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। তবে কষ্টও লেগেছে অনেকখানি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রাণ দিয়েছে আমাদের দেশের লাখো মানুষ। অনেক চেনা মুক্তিযোদ্ধাও হারিয়েছি আমি।
এনটিভি অনলাইন : শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কী ধরনের গান আপনারা গাইতেন?
শাহীন সামাদ : লোক সংগীত বেশি গিয়েছি। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, জাগরণমূলক গান, দেশাত্ববোধক গান অনেক গেয়েছি। ‘এই শিকল পরা ছল’,‘কারার ওই লৌহ-কপাট’, ‘হবে জয় হবে জয় হবে জয় রে’ _এই গানগুলো মুক্তিযোদ্ধারা শুনে খুব উদ্বুদ্ধ হতেন। তখন আমার বয়স কম ছিল। সাহসও ছিল অনেক। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক ট্রেনিং ক্যাম্পে ঘুড়ে ঘুড়ে গান গেয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : শরণার্থী ক্যাম্পে গান গাওয়ার সময় অনেক কিছু স্বচক্ষে দেখেছেন। কোন ঘটনার কথা বলবেন কি?
শাহীন সামাদ : একদিন ক্যাম্পে এক বৃদ্ধার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তাঁর কথা আমি ভুলেতেই পারি না। তাঁর ৪০ বছর বয়স ছিল। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর স্বামী, সন্তান ও পুরো পরিবারের সবাই শহীদ হয়েছিলেন। প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি একাই। তাঁকে দেখে খুব মায়া হয়েছিল। অনেক আদর করেছিলাম তাঁকে। যুদ্ধের সময় কত যে ক্ষত-বিক্ষত মানুষের হৃদয় দেখেছি। যাঁরা যুদ্ধ করে বেঁচে গেছেন তাঁদের মধ্যে কারো কারো হাত কেটেছে, পা কেটেছে। আহ কী কষ্টের!
এনটিভি অনলাইন : ছায়ানটে আপনি অনেক তরুণ শিল্পীকে গান শেখাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম কতখানি দেখতে পান?
শাহীন সামাদ : সত্যি বলতে আমি তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম দ্বিগুণ দেখতে পাই। তরুণদের নিয়ে আমি আশাবাদী। আমাদের দেশ স্বাধীন। আমরা মুক্তভাবে কথা বলছি। দেশ কত এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে। এ প্রজন্মের সবাই এখন দেশের হাল ধরবে। আমাদের দেশটাকে প্রতিনিয়ত বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। দেশকে ভালোবাসবে। এটাই তাঁদের এখনকার মুক্তিযুদ্ধ। তরুণদের মধ্যে গান গাওয়ার স্পৃহা আমি অনেক দেখতে পাই। তাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদীও।
এনটিভি অনলাইন : আপনার জীবনে অনেক প্রাপ্তি। কোনো বিষয়ে অতৃপ্তি অনুভব করেন কি?
শাহীন সামাদ : একদম না। মাঝে মাঝে ভাবি মানুষের কত ভালোবাসা পেয়েছি। মনে-প্রাণে সবাই ভালোবাসেন। তবে একটা জিনিস সবার কাছে চাইব তা হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক নতুন গান করা হয়েছিল। একাত্তরের সেই গানগুলো সব আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। একটা বড় আর্কাইভ হলে ভালো হবে। কারণ অনেক গান হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা আশির দশকের গান বেশি শুনতে পাই কিন্তু একাত্তরের গানগুলোও আমাদের মনে রাখতে হবে। চর্চা করতে হবে।