বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতে অগ্রজনেরা
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বড় আশ্রয়। কি সাহিত্য, কি কবিতা, কি গানে। তবে তিনি সংগীতে এক অমর গাঁথা তিনি রচনা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর গানের ভুবনের শ্রেষ্ঠ রূপকার, যার খুব সামান্যই প্রমাণ হিসেবে নিদর্শন পাওয়া যায় সাহিত্য-সংস্কৃতিমালায়। তাঁর গাওয়া সেইসব গান যখন অন্যের কণ্ঠে গীত হয় তখনই গীতিকার, সুরকার ও রূপকার রবীন্দ্রনাথের অনন্যতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিশ্বসংস্কৃতির এক অভেদ্য জগৎ হলো রবীন্দ্রসংগীত। আমাদের সংস্কৃতি পরিপুষ্ট হয়েছে এই সংগীতের অর্চনায়। মনোমুগ্ধকর এই সংগীত সমাদৃত হয়েছে কালের যাত্রায় দেশে-বিদেশে। আর বাংলা সংগীত ধারাকে আরো সমৃদ্ধ করতে নিরলস কাজ করে চলেছেন দেশবরেণ্য প্রথিতযশা শিল্পীরা, যাঁরা রবীন্দ্রসংগীতের জাদুমন্ত্রে মুগ্ধ করতে চান দেশের সাধারণ শ্রোতাদের। তাই রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী (২৫ বৈশাখ) এবং প্রয়াণ দিবসকে (২২ শ্রাবণ) ঘিরে আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচি। এবারের ২২ শ্রাবণের আয়োজন নিয়ে দেশবরেণ্য শিল্পীদের রবীন্দ্র-ভাবনা তুলে ধরা হলো আলোচনাটিতে।
আবার জাগিয়ে দিয়ে যাক রবীন্দ্রনাথ
—পাপিয়া সারোয়ার
আমার রক্তেই যেন মিশে ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। যে সময়টায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি এতটা ভালোবাসা তৈরি হয়, তখন রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াটা ছিল কড়া নিষেধ। অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় রবীন্দ্রসংগীতের ঝোঁকটা বেড়েই চলে। পাপিয়া সারোয়ার জানান, আমি তখন ছোট, আমার মা পিয়ানো বাজিয়ে গান করতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম। বাবাও গান করতেন, বাসায় ছিল সব রকমের বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ। ভাইবোনরা সবাই গানবাজনা করতেন। আমাদের পারিবারিকভাবেই ছিল সংগীতের মনোরম পরিবেশ। শিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ছায়ানটে। সন্জীদা খাতুনের কাছে। এর পর বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে সংগীতের কোর্স সম্পন্ন হয়।
হঠাৎ একদিন কচিকাঁচার মেলায় রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখেই রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। শিল্পী যখন নবম শ্রেণিতে পড়েন, তখন থেকেই শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীত চর্চা। বাংলাদেশ বেতারে তখন স্পেশাল রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ডিং করতে ডাক পেতেন শিল্পী। এর পর উচ্চতর সংগীত শিক্ষার জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম স্কলারশিপ নিয়ে রবীন্দ্রভারতীতে যান। ভারতে তিনি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, আরতি বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিনয় রায়ের মতো সংগীতজ্ঞদের কাছে তালিম নিয়েছেন। এ ছাড়া আশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়া সেন ও দেবব্রত বিশ্বাসের কাছেও তাঁর গান শেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ থেকে। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তারপরই বিশ্বভারতীতে বৃত্তি নিয়ে চলে যান।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিটিভিতে প্রথম ‘আনন্দলোক’ নামে যে অনুষ্ঠানটি হতো সেটির গ্রন্থনা, পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা তিনি নিজেই করতেন। অনেক পরিকল্পনা করে তিনি অনুষ্ঠানটি করতেন। এর পর ২০০০ সালে চ্যানেল আইতে বাইশে শ্রাবণে সকালে গানের অনুষ্ঠানটি প্রথম শুরু করেন, যার ধারাবাহিকতায় এ অনুষ্ঠান এখন দেশের মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সংগীতের অন্যান্য ধারায় দক্ষতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন। গেয়েছেন ‘নাই টেলিফোন নাই রে পিয়ন’-এর মতো অনেক জনপ্রিয় গান। কিন্তু হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ যে বাসা বেঁধে ছিল, তা প্রচারেই তিনি যেন মরিয়া হয়ে ছিলেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মকে ভালোবেসে সারা জীবন রবীন্দ্রসংগীতের সুরের জাদুতে সবাইকে মুগ্ধ করে চলেছেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এ ছাড়া জাতীয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সংস্থায় দীর্ঘ চার বছর কাজ করেছেন। বর্তমানে নিজে যা শিখেছেন, তা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গীতসুধা অনুশীলন কেন্দ্র নামে সংগঠনটি তিনি পরিচালনা করে আসছেন। শিল্পী বললেন, আবার জাগিয়ে দিয়ে যাক রবীন্দ্রনাথ সহজ-সরল জীবনের তরে। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আছি, তা নিয়েই থাকব আজীবন।
গানের কাঁড়ি কাঁড়ি অ্যালবাম বের করায় তিনি আগ্রহী নন। তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে গান করলেও সে তুলনায় আমার অ্যালবামের সংখ্যা খুব কম। তবে যে কয়েকটি অ্যালবাম করেছি, তা সুন্দরভাবে করার চেষ্টা করেছি। অনেক যত্ন নিয়ে অ্যালবাম করতে না পারলে তা না করাই ভালো।’ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়েছে শিল্পীর ‘আকাশ পানে হাত বাড়ালাম’ আর বাংলাদেশের জি সিরিজ থেকে বেরিয়েছে ‘পূর্ণ চাঁদের আলোয়’, ‘অগ্নিবীণা থেকে চোখের দেখা প্রাণের কথা’ অ্যালবামগুলো। শিল্পী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তরুণ রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি বলেন, সঠিকভাবে চর্চা করতে হবে, শুদ্ধ উচ্চারণ করে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে হবে। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো হলো শ্রুতিমধুর। তাই উচ্চারণ যদি শুদ্ধ না হয় তো, তা শুনতে শ্রুতিমধুর লাগে না। যতদিন গাইতে পারবেন, ততদিন রবীন্দ্রনাথকেই নিয়েই থাকতে চান পাপিয়া সারোয়ার।
আমরা যেন সংস্কৃতি চর্চা করে জাতিসত্তার উন্নতি ঘটাতে পারি
—মিতা হক
মিতা হক, আলাদাভাবে পরিচয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। সংগীতপ্রেমী পরিবারে বড় হওয়ায় গানের জন্য তিনি আলাদা কোনো স্কুল বা একাডেমিতে ভর্তি হননি। প্রথমে চাচা ওয়াহিদুল হক এবং পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সন্জীদা খাতুনের কাছে বাড়িতেই গান শেখেন তিনি। এর পর ১৯৭৭ সাল থেকে গণমাধ্যমে গাইতে শুরু করেন। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই পথ চলছেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে সহসভাপতি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শেখাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে আমাদের জাতীয় সংগীতটি শুদ্ধভাবে পূর্ণ রেকর্ডিংয়ের পুরো মহড়া তিনি পরিচালনা করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন কর্মশালা, সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রচার ও প্রসারে রয়েছে শিল্পীর অপরিসীম সাধনা। বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম বাজারে রয়েছে এই গুণী শিল্পীর। এ ছাড়া বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে ‘বেলা বয়ে যায়’ নামে পঞ্চকবির গান নিয়ে একটি অ্যালবামও রয়েছে। মিতা হক বলেন, রবীন্দ্রনাথ যে কত সুন্দর, সহজ-সরল জীবনের কথা বলে গেছেন, তা যদি আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি, আমাদের জীবন ভালোবাসায় ভরে উঠবে। তাই আমরা যেন সংস্কৃতি চর্চা করে জাতিসত্তার উন্নতি ঘটাতে পারি, তাহলেই কেবল আমাদের জীবনে দুঃখ-সুখের কোনো হতাশা থাকবে না।
আমরা যেন রবীন্দ্রনাথের জীবন বোধ স্মরণ করি
—সাদী মহম্মদ
সাদী মহম্মদ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশ্বভারতী থেকে পড়াশোনা করেছেন। ফিরে এসে সেই যে পথচলা শুরু হয়েছে, তা রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই গবেষণা, সংগীত ভাবনায় নির্দিষ্ট থাকেনি; বরং তা ছড়িয়ে দিতে শিল্পীর অপরিসীম সাধনার ছাপ তাঁর কণ্ঠের গান। রাবীন্দ্রিক জাদুমন্ত্রে তিনি বাংলাদেশের রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। শিল্পীজীবনের এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করেছেন অনেক। তাঁরই ফল হিসেবে শিল্পীর প্রায় ৬৩-৬৪টি অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। পঞ্চকবি নিয়ে আরো একটি অ্যালবাম বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ পর্যন্ত অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। বাইশে শ্রাবণ নিয়ে সাদী মহম্মদের রয়েছে অনেক আয়োজন। এশিয়ান টিভি, চ্যানেল আই, বাংলা একাডেমি, বাংলাভিশন, মাছরাঙা—এই চ্যানেলগুলোতে তিনি গান করবেন। তিনি বলেন, শুধু বাইশে শ্রাবণ নয়, রবীন্দ্রনাথ যেন বছরজুড়েই আমাদের মাঝে থাকেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি যতটুকু শিখেছেন, তা বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে; শিল্পীর পরিচালিত সংগঠন রবিরাগ থেকে। রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতিকর্ম প্রচারে শিল্পীর রয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা ও সাধনা। সাদী মহম্মদ বলেন, রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শন নিয়ে যেন সবাই ভাবি। রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রখরতা আমরা যেন স্মরণ করি। তাহলেই কেবল বাস্তবজীবনে রবীন্দ্র-ভাবনার প্রকাশ ঘটবে। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ৩০ শ্রাবণ সাদী মহম্মদের সংগঠন রবিরাগ পাবলিক লাইব্রেরিতে আয়োজন করেছে ‘বর্ষামঙ্গল’। রবিরাগ সঙ্গে রেখেছে নৃত্যাঞ্চল-কে। অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সাদী মহম্মদ বলেন, ৩০ শ্রাবণ রবিরাগের বর্ষামঙ্গলে সবাই স্ববান্ধব আমন্ত্রিত। রবিরাগ গত ৩০ বছর রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতিকর্ম প্রচারে কাজ করে আসছে। এবং তা দর্শনীর বিনিময়ে নয়। এ অনুষ্ঠানগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত, কেননা আমরা চাই রবীন্দ্রনাথ-ভাবনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক।