পোড়া হৃদয়ের পাশে ডিপজল
সোমবার সকালে একটি টিভি চ্যানেলের স্ক্রলে খবরটি দেখেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ও প্রযোজক ডিপজল। খবরটি হলো- রাজধানীর ধলপুর বস্তিতে দুই শিশু আগুনে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একজনের অবস্থা খুব খারাপ। অন্যজনের অবস্থা অতো খারাপ নয়। খবরটি দেখে তখনই অস্থির হয়ে ওঠেন ডিপজল। সাহায্য করতে চান তিনি পরিবারটিকে। ডিপজল ফোন দিলেন পরিচিত কয়েকজনকে। খুঁজে বের করতে হবে আহতদের। পরিচিতরা ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করে সেই আহতদের। শেষে সন্ধ্যার দিকে খুঁজে পাওয়া যায় তাদের।
জানা গেল, ধলপুর বস্তিতে আগুনে পোড়া দুই শিশু, একে অপরের খালাত ভাই। ডিপজলের এই পুরো অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে যাই আমরাও। মিডিয়ার লোকজন এসেছে শুনে আমাদের সামনে এলেন মৃত্যুশয্যায় থাকা হৃদয়ের বাবা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দোতলায় আইসিইউতে তার ছেলে হৃদয় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। অবস্থা ভালো নয়। কীভাবে কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।’ কথা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন তিনি।
পুরো ঘটনা জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ধলপুর বস্তিতে থাকি আজ তিন বছর। রিক্সা চালাই, বাড়ি ইশ্বরগঞ্জ। এদিকে হৃদয়ের মা আবারও মা হয় গত ১২ জুলাই। এজন্য রবিবার দুপুরে হাসপাতালে ভর্তি করি তাকে। ডাক্তার দেখেই বলেন অবস্থা ভালো না সিজার করাতে হবে। বিকেলে সিজারে হৃদয়ের ভাইয়ের জন্ম হয়। নতুন বাচ্চা আর আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে রাতে আমরা বাসায় গিয়ে ঘুমাই। রাতে আগুনের তাপে সজাগ হয়ে সবাইকে বাইরে আনতে পারলেও আলিফ আর হৃদয়কে আনতে পারিনি। এলাকার মানুষের সহযোগিতায় এদের বাসা থেকে বের করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। আলিফ মোটামুটি ভালো আছে, কিন্তু হৃদয়ের অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তার বলেছে ৩-৪ লাখ টাকা লাগবে। সিজার করেছি এখন ভাত খাওয়ারই টাকা নাই, এত টাকা আমি পাব কোথায়? যে টাকা রিকশা চালিয়ে পাই তা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে। কিছু টাকা জমা ছিল ঘরের একটা ট্রাঙ্কে। সেই টাকাও সব পুড়ে শেষ, কিছুই বের করতে পারি নাই।’
নুরুল ইসলাম আরো জানান, অলিফ তার ছেলে নয়, হৃদয়ের খালাতো ভাই। দুই বছর বয়সেই অলিফের মা মারা যায়। তারপর থেকে সে তার নানির কাছে থাকে। নানিকে মা বলে ডাকে। নানিসহ সবারই ভরণপোষণ করেন রিকশাচালক নুরুল ইসলাম।
নুরুল ইসলামকে সান্তনা দিয়ে আমরা গেলাম বার্নইউনিটে। সেখানে দেখা গেল হৃদয়কে, সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, কাঁদছে কিন্তু শব্দ করছে না। ডাক্তার গুলশান আরা বলেন, ‘৪৫ ভাগ শরীর পুড়ে গেছে। ৩০ শতাংশের বেশি হলেই আমরা এটাকে ইমার্জেন্সি মনে করি। তার শ্বাসনালিতে সমস্যা হয়েছে। ঠিকমতো চিকিৎসা দিলে আর দুই মাসের মতো হাসপাতালে থাকতে পারলে ভালো হয়ে যাবে।’
এরই মধ্যে নুরুল ইসলামের মোবাইলে ফোন আসে, সে একটু পাশে গিয়ে কথা শেষ করে আমাদের কাছে এসে বলে, ‘হৃদয়ের মা ফোন দিয়েছিল, সে জানতে চায় ভাই হওয়ায় হৃদয় রাগ করেছে কি না। কেন সারাদিন হৃদয় আসছে না। খুব ক্ষুধা লেগেছে পারলে রাতে যেন খাবার পাঠাই। আমি এখন কী করব?’ এটা বলে কেঁদে দেন নুরুল ইসলাম।
আমাদের সঙ্গে থাকা ডিপজলের পাঠানো সেই লোক তখন নুরুল ইসলামের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন। তিনি নুরুল ইসলামকে বলেন, ‘আজ সকালে মনোয়ার হোসেন ডিপজল কোনো এক টিভিতে তাদের বিষয়টি দেখে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা আজ আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছি, আপনারা চিকিৎসা করান আর আমার নম্বরটা রাখেন যেকোনো প্রয়োজনে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। মনোয়ার হোসেন ডিপজল হৃদয় ও আলিফের চিকিৎসার খরচ বহন করবেন।’
এমন বিপদের দিনে হঠাৎ করে এমন সহযোগিতা পেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নুরুল ইসলাম আর তার সাথে থাকা স্বজনরা।