মৃত্যুর ২০ ঘণ্টা আগে স্ত্রীর আবেগময় স্ট্যাটাস
জীবনের গল্প শেষ করে পরপারে পাড়ি জমালেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় নিজ বোনের বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর ঠিক ২০ ঘণ্টা আগে গতকাল (৫ জুলাই) তাঁর স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন। কিংবদন্তি শিল্পীর শারীরিক অবস্থাসহ আবেগঘন অনেক কথাই লেখেন লিপিকা।
স্ট্যাটাসটি অবশ্য এন্ড্রু কিশোরের একটি অফিশিয়াল পেজ থেকে লেখা। তাই অনেকের হয়তো সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, এই ভেবে শুরুতেই লিপিকা লিখেছেন, ‘অনেকেই ভাবছেন এটা আসল না নকল। আসল যারা ভেবেছেন তাদের জন্য শুভকামনা। প্রথম যে পোস্ট দুইটা দেয়া হয়েছে সেটা এন্ড্রু কিশোরের কথা। আমি শুধু মাত্র লিখেছি। আমি কিশোরের বউ। এখন আমি কিছু বলবো।’
পরে লিপিকা গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার শুরু থেকে চিকিৎসাসহ ধারাবাহিক বর্ণনা দেন। এরপর লেখেন, ‘Cancer এর last stage খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। Andrew Kishor এর জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে। আমার মনে হলো, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত শ্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটাই শেষ পোস্ট, এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন আর Andrew KIshor এর প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন। বিদায়।’
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে আজ সকাল থেকেই এন্ড্রু কিশোরকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল বলে বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোরের ঘনিষ্ঠজন মোমিন বিশ্বাস। সন্ধ্যায় ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোমিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দাদা আর নেই।’
দুদিন ধরে এন্ড্রু কিশোরের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। আজ সকাল থেকে অবস্থার আরো অবনতি হয়। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। ফলে তাঁকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যেই সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ আসে সংগীত অঙ্গনে।
বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেতাই শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। অপরদিকে এই গুণী শিল্পীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে গভীর শোক নেমে আছে।
দীর্ঘ নয় মাস পর গত ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন এন্ড্রু কিশোর। তবে করোনার কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে এর আগে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছিলেন মোমিন বিশ্বাস।
উন্নত চিকিৎসার জন্য গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিল। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তাঁর চিকিৎসা হয়।
এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।
বাংলা গানের কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ হিসেবেও পরিচিত। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে তাঁকে বলা যেতে পারে এক মহাসমুদ্র। কয়েক দশক ধরে সেই সমুদ্রে সাঁতার কেটে চলেছেন শ্রোতারা। ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘চোখ যে মনের কথা বলে’সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান রয়েছে তাঁর।
এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তানের নাম সংজ্ঞা আর দ্বিতীয় জনের নাম সপ্তক।