প্লেব্যাক সম্রাটকে হারিয়ে চলচ্চিত্র অঙ্গনে শোক
চলচ্চিত্রপাড়ায় ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত ছিলেন বরেণ্য সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। তাঁর সেই চিরসবুজ গানগুলো এখনো সবার কানে বেজে ওঠে। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে চলচ্চিত্র অঙ্গনে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র-প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যাঁর গানে শুনে চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়, তিনি এন্ড্রু কিশোর। শুধু আমরা চলচ্চিত্রের মানুষই নই, বিশ্ব আজ একজন শিল্পীকে হারাল। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমাদের প্লেব্যাক সম্রাটের আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের চলচ্চিত্রে এমনিতেই শূন্যতা বিরাজ করছে, এর মধ্যে আমাদের প্লেব্যাক সম্রাটের চলে যাওয়া, শূন্যতাকে আরো বাড়িয়ে দিল বহু গুণ। সবাই দোয়া করবেন, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।’
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘চলচ্চিত্রে আসার আগে যাঁর গান শুনে লাখোবার মনে মনে গেয়েছি আর নিজের নায়ক ভেবেছি, সেই স্বপ্নদ্রষ্টা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি চলচ্চিত্র শিল্পীদের পক্ষ থেকে শোক জানাচ্ছি। সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন।’
বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাবের সভাপতি অমিত হাসান বলেন, ‘দাদার কণ্ঠের সঙ্গে বহু ছবিতে ঠোঁট মিলিয়েছি। অভিনয় করার সময় ভুলে যেতাম... কখন শট শেষ হয়ে যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়া, তিনি যেন ওপারেও সম্রাটের স্থানে থাকেন। এই কিংবদন্তির মৃত্যুতে আমার ফিল্ম ক্লাবের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করছি।’
দেশের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান বলেন, ‘চলচ্চিত্রের এই সময়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছি, কীভাবে কী করা যায়। কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় চলচ্চিত্রকে। এমন সময় কিশোরদার একটি কথাও আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমন শিল্পীদের মরণ নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। ওপারে ভালো থাকবেন দাদা।’
এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন মিশা সওদাগর। ফেসবুকে লেখেন, ‘দাদা, আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা... আপনি ভালো থাকুন।’
নায়ক বাপ্পী চৌধুরী লেখেন, ‘আপনি শ্রদ্ধার অনেক উচ্চ শিখরে ছিলেন আছেন থাকবেন।’ নায়িকা শাকিবা নিজের ফেসবুকে লেখেন, ‘ওপারে ভালো থাকবেন দাদা। আমরা আমাদের অতুলনীয় পথপ্রদর্শককে হারালাম। ধীরে ধীরে সবাই চলে যাচ্ছে রেখে অমলিন স্মৃতি...।’
আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় আপন বোনের বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।
সন্ধ্যায় বিষয়টি এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেন এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান দীপকেন্দ্র দাশ। তিনি বলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর তাঁর বোনের বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।’
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে আজ সকাল থেকে এন্ড্রু কিশোরকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল বলে বিকেলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোরের ঘনিষ্ঠজন মোমিন বিশ্বাস। সন্ধ্যায় ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোমিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দাদা আর নেই।’
দুদিন ধরেই এন্ড্রু কিশোরের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। আজ সকাল থেকে অবস্থার আরো অবনতি হয়। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। ফলে তাঁকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যেই সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ আসে সংগীত অঙ্গনে।
বরেণ্য এই শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই নেতাই শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। অপরদিকে এই গুণী শিল্পীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে গভীর শোক নেমে আছে।
ক্যানসারের চিকিৎসা শেষে দীর্ঘ নয় মাস পর গত ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন এন্ড্রু কিশোর। তবে করোনার কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে এর আগে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছিলেন মোমিন বিশ্বাস।
উন্নত চিকিৎসার জন্য গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছিল। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তাঁর চিকিৎসা হয়।
১৯৫৫ সালে এন্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। সেখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।
এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে। সেখানে তিনি ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তাঁর কেউ’ গানে কণ্ঠ দেন। তার রেকর্ডকৃত দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ চলচ্চিত্রের ‘ধুম ধাড়াক্কা’। তবে এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রতিজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গাওয়া গান প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্লেব্যাকে তাঁর গানের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি।
‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমারই ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘চোখ যে মনের কথা বলে’সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান রয়েছে তাঁর।
এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। প্রথম সন্তানের নাম সংজ্ঞা আর দ্বিতীয় জনের নাম সপ্তক।