লক্ষাধিক টাকায় বদলি পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার দিতে এসে ধরা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি করে উত্তীর্ণ হওয়া ১২ ভর্তিচ্ছুকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মঙ্গলবার তৃতীয় দিনের সাক্ষাৎকারে এসে আটক হয়েছেন চারজন। এর আগে গত দুদিন সাক্ষাৎকার দিতে এসে আটক হয়েছে চারজন করে মোট আটজন ভর্তিচ্ছু।
মূলত ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্রের লেখার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দেওয়া হাতের লেখার মিল না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকার বোর্ড তাদের ভর্তির জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করে প্রক্টর কার্যালয়ে হস্তান্তর করে।
প্রক্টর কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে আটকদের অধিকাংশই তাঁদের অপরাধ স্বীকার করে জানিয়েছেন, বড় অঙ্কের টাকার চুক্তিতে তাঁদের হয়ে জালিয়াত চক্রের সদস্যরা বদলি পরীক্ষা দেওয়ায় তাঁরা উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের নামে মামলা দিয়ে পুলিশে হস্তান্তর করেছে।
মঙ্গলবার আটক চারজনের একজন ময়মনসিংহের চরভিলা গ্রামের ইয়াসীন আরাফাত। তিনি ‘সি’ ইউনিটে পঞ্চম হন। আরেকজন নাটোরের লালপুর উপজেলার আবু রায়হান। তিনি ‘সি’ ইউনিটে ১৩তম হন। আটক রাকিব হোসেনের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায়। তিনি ‘সি’ ইউনিটে ৫৮তম হন। আটক আরেকজন গাজীপুরের শ্রীপুরের শেখ পারভেজ আহমেদ। তিনি ‘সি’ ইউনিটে ১৫৫তম হন।
জিজ্ঞাসাবাদে পারভেজ ও রাকিব জানান, তাঁরা যথাক্রমে চার লাখ ও আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হন। তাঁদের হয়ে অন্যরা বদলি পরীক্ষা দিলে তাঁরা উত্তীর্ণ হন।
আবু রায়হান জানান, বদলি পরীক্ষার জন্য জালিয়াত চক্রের সঙ্গে দুই লাখ টাকার চুক্তি হয় তাঁর।
তবে ইয়াসীন আরাফাত জালিয়াতির কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার পরীক্ষা আমি নিজেই দিয়েছি। হাতের লেখায় মিল না পাওয়ায় আমাকে আটক করা হয়েছে।’
এর আগে সোমবার আটক করা হয় চারজন। এর মধ্যে একজন নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার মুন্সীপাড়া গ্রামের নিশাদ আহমেদ। ‘এফ’ ইউনিটে (আইন ও বিচার বিভাগ) ভর্তি পরীক্ষায় তিনি ৪৭তম হন। তাঁর রোল নম্বর ছিল ৬৩২১৩৬। বদলি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য জালিয়াত চক্রের সঙ্গে তিন লাখ টাকার চুক্তি করেন তিনি।
উপজেলার হাতিখানা গ্রামের নাঈমুর রহমানও সোমবার আটক হন। ‘ই’ ইউনিটে (বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ) ১২৭তম হন তিনি। বদলি পরীক্ষার জন্য সুবীর নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে দুই লাখ টাকার চুক্তি করেন।
আরেকজন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাকুড়া গ্রামের আশরাফুজ্জামান নয়ন। ‘সি’ (কলা ও মানবিকী অনুষদ) ইউনিটে ১৭তম স্থান লাভ করেন তিনি। তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করে এক ব্যক্তির সঙ্গে বদলি পরীক্ষার চুক্তি করেন।
আটক মাহমুদুর রশিদ সৌরভের বাড়ি গাজীপুরের জয়দেবপুরে। ‘ই’ ইউনিটে (বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ) তিনি ১৫২তম হন। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে বদলি পরীক্ষার চুক্তি করেন জালিয়াত চক্রের সঙ্গে।
রোববার আটক চারজনের একজন বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার মাহবুব হোসেন। ‘ই’ ইউনিটে (বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ) তৃতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি ভর্তি জালিয়াতি চক্রের সদস্য সনদের সঙ্গে সাড়ে তিন লাখ টাকা চুক্তি করেন।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ইমাম হোসেন ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে রাহাত নামের একজনের সঙ্গে চুক্তি করেন। তিনি ‘এফ’ ইউনিটে (আইন ও বিচার অনুষদ) তৃতীয় স্থান লাভ করেন।
ঢাকার কেরানীগঞ্জের অমিত হাসান ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে সনেট নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করেন। তিনি ‘এইচ’ (আইআইটি) ইউনিটে ১১তম স্থান লাভ করেন।
কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার আশিকুল হাসান রবিন ‘এফ’ (আইন ও বিচার অনুষদ) ইউনিটে ১৬তম স্থান লাভ করেছিলেন। হাতের লেখার সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্রের লেখার মিল না পাওয়ায় তাঁকে রোববার আটক করা হয়।
রবিন জালিয়াতির কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কোনো জালিয়াতি করি নাই। আমি নার্ভাস থাকার কারণে ঠিকমতো লিখতে পারি নাই।’
আটকদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তপন কুমার সাহা বলেন, ‘হাতের লেখার মিল না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ভাইভা বোর্ড তাঁদের ভর্তির অনুপযুক্ত ঘোষণা করে আমাদের কাছে পাঠায়। দু-একজন ছাড়া প্রায় সবাই জিজ্ঞাসাবাদে বদলি পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। মামলা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার মাধ্যমে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী পুলিশ বাকি ব্যবস্থা নেবে।’
যারা অস্বীকার করেছে তাদের ব্যাপারে প্রক্টর বলেন, ‘ভাইভা বোর্ড যৌক্তিক কারণেই তাদের ভর্তির অনুপযুক্ত ঘোষণা করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। তারা অস্বীকার করলেও আমরা তাদের নির্দোষ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারিনি। পুলিশের তদন্তে এবং আদালতে প্রমাণিত হবে তারা নির্দোষ কি না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় উত্তরপত্রে বাংলা ও ইংরেজিতে দুটি বাক্য লিখতে হয়। উত্তীর্ণ হওয়ার পর হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার জন্য সাক্ষাৎকারের সময় শিক্ষার্থীদের ফের দুটি বাক্য লিখতে দেওয়া হয়। আটক ভর্তিচ্ছুদের উত্তরপত্রের হাতের লেখার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের হাতের লেখার মিল না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকার বোর্ড তাঁদের ভর্তির জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করে। জিজ্ঞাসাবাদে অধিকাংশই জালিয়াতির কথা স্বীকার করে।