পাওয়ার কথা স্যালুট, ছাত্রলীগ বানাল দেশদ্রোহী!
জাতীয় শোক দিবসে একটি বিভাগে ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ এনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) প্রশাসনিক ভবনসহ অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোতে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করেছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সভা, সমাবেশ ও মিছিলে সিন্ডিকেটের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
আজ বুধবার সকাল ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর বিক্ষোভ শুরু করেন। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার ওই শিক্ষককে বিভাগ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পক্ষে সভাপতি মো. ইলিয়াস হোসেন (সবুজ) স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন, ১৫ আগস্ট কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী পালন করছিল। কিন্তু গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া (তারেক) তার বিভাগের প্রথম ব্যাচের ক্লাস নেন, যা জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধার পরিপন্থী, যা জাতির জনকের মতো মতো মহান ব্যক্তির মান ক্ষুন্ন করেছেন, যা একটি দেশদ্রোহী কাজ। আমরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার মতো দেশদ্রোহীর বহিষ্কার দাবি করছি। …অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবে।
তবে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাঁদের দ্বিতীয় পরীক্ষা আজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আজকের পরীক্ষাটি ব্যবহারিক হওয়ায় সেটি নিয়ে নানা সমস্যার কথা শিক্ষার্থীরা বিভাগের সভাপতি মাহবুবুল হক ভূঁইয়াকে জানান। পরে বিভাগের সভাপতি জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়ার পর অফিসে তাঁদের ডাকেন। ওই ব্যাচের ৪৮জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ জন শিক্ষার্থী গতকাল তাঁর কাছে যান। তবে মাহবুবুল হক ভূঁইয়ার কক্ষে জায়গা না হওয়ায় তিনি সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের ১০৬ কক্ষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসেন। সেখানেই পরীক্ষার বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিভাগের সভাপতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে কথা বলার সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে সেখানে যান। পরে ওই কক্ষে তাঁদের দেখে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখান থেকে চলে যান।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানানো শেষে গতকাল দুপুরে প্রশাসনিক ভবনের ৪১১ নম্বর কক্ষে আলোচনা সভা চলছিল। এ সময় নেতাকর্মীরা সামাজিক বিজ্ঞান ভবনে ‘ক্লাস হচ্ছে’ এমন তথ্য পেয়ে মিছিল নিয়ে সেখানে যান। ক্লাস রুমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি মাহবুবুল হক ভূঁইয়াকে দেখে নেতাকর্মীরা সেখান থেকে প্রশাসন ভবনে আসেন। তাঁরা ওই শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি করে দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত প্রশাসন ভবনের ফটকে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ শেষে উপাচার্যের কাছে ওই শিক্ষকের বহিষ্কার দাবিতে স্মারকলিপি দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজ ছাত্রলীগের চলমান বিক্ষোভের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি বিভাগের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি বিভাগে মোট ১১টি সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক ভবনে এখনো তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করছেন নেতাকর্মীরা।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে আজ বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিক্ষোভ। ছবি : এনটিভি
এ বিষয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি মাহবুবুল হক ভূঁইয়া বলেন, যাঁদের ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে, সে ব্যাচের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। এরই মধ্যে একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিতও হয়েছে। সুতরাং এখন তাদের কোনো ক্লাস নেওয়ার সুযোগ নেই।
মাহবুবুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘মঙ্গলবার যা ঘটেছে সেটি এরকম, আমি সকালে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ক্যাম্পাসে আসি। এরপর যথারীতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে ফুল প্রদান শেষে ওইখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। এর মধ্যে কিছু স্টুডেন্ট এসে বলে, তাঁরা কিছু বিষয় বুঝছে না, একটু সময় দিতে। আমি তাঁদের ডিপার্টমেন্টে আমার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বলি। এর কিছুক্ষণ পর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, ওঁরা (শিক্ষার্থী) সংখ্যায় প্রায় ১০-১২ জন। আর এর মধ্যেই আমার আরেকজন সহকর্মী অন্য ডিপার্টমেন্টের আরো দুজন সহকর্মীসহ রুমে আসেন। এ অবস্থায় তাঁদের সঙ্গে ওই রুমে বসে কথা বলা সম্ভব ছিল না, কারণ রুমে এত মানুষের বসার জায়গা ছিল না। আমি স্টুডেন্টদেরকে পাশের একটি রুমে বসতে বলি এবং নিজেও একটু পরে সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’
‘আদতে ওই ব্যাচের ক্লাস অনেক আগেই শেষ। সেমিস্টার ক্যালেন্ডার এবং এরই মধ্যে শুরু হওয়া সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন সে প্রমাণই বহন করছে। সুতরাং ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়। এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।’
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি আরো বলেন, ‘এরই মধ্যে কিছু অনলাইন সংবাদমাধ্যমে আমি ক্লাস নিয়েছি বলেছি মর্মে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। বস্তুত আমি কোনো সংবাদমাধ্যমকে এমন বক্তব্য দিইনি। যেহেতু এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’
আজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, ‘ওই শিক্ষক শোক দিবসে ক্লাস নিয়ে শোক দিবসকে অস্বীকার করেছেন। তাই আমরা তাঁর বহিষ্কার চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিবে, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
তবে বিভাগের সভাপতি মাহবুবুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি ক্লাস নিচ্ছিলাম কিনা এ বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হোক। বিভিন্ন সময়ে আন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলায় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আমাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আশরাফ বলেন, ‘আমি একটা অভিযোগ পেয়েছি। যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’