অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে লাঞ্ছিত : ৪ ছাত্রলীগ নেতাকে স্থায়ী বহিষ্কার
রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিনকে লাঞ্ছিত ও ধাক্কা দিয়ে পুকুরের ফেলে দেওয়ার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির চার শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কারসহ ১৬ ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অপরাধী চিহ্নিত হওয়া এসব ছাত্র সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এরই মধ্যে এসব সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বার্তা সংস্থা ইউএনবি এ খবর জানিয়েছে।
অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কাম প্রশাসনিক পরিষদের সভায় সম্প্রতি এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চার শিক্ষার্থীকে স্থায়ী বহিষ্কার, পাঁচ শিক্ষার্থীর মূল সনদপত্র আগামী তিন বছর আটকে রাখা ও সাত শিক্ষার্থীকে টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) দিয়ে অন্য কোনো ইনস্টিটিউটে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় যাদের ছাত্রত্ব বাতিল বা রেজিস্ট্রেশন বাতিলের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন—অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলার মূল হোতা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ২০১৫-১৬ সেশনের কম্পিউটার বিভাগের অষ্টম পর্বের শিক্ষার্থী কামাল হোসেন ওরফে সৌরভ, একই সেশনের ইলেকট্রনিকস মেডিক্যাল বিভাগের সপ্তম পর্বের শিক্ষার্থী রায়হানুল ইসলাম, ২০১৭-১৮ সেশনের ইলেকট্রনিকস বিভাগের পঞ্চম পর্বের ছাত্র মুরাদ হোসেন ও ২০১৮-১৯ সেশনের মেকানিক্যাল বিভাগের তৃতীয় পর্বের শিক্ষার্থী সাজিব হোসেন।
সরাসরি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা পাঁচ শিক্ষার্থীর মূল সনদপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র আগামী তিন বছরের জন্য আটকে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ২০১৫-১৬ সেশনের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের কৌশিক জামান ওরফে বনি, ইলেকট্রো-মেডিক্যাল বিভাগের সালমান রহমান ওরফে টনি, পাওয়ার বিভাগের সাব্বির অহম্মেদ, মেকাট্রনিকস বিভাগের হাসিবুল হাসান ও কম্পিউটার বিভাগের মারুফ হোসেন।
এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে সাত শিক্ষার্থীকে অন্যত্র বদলি করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন ২০১৫-১৬ সেশনের পাওয়ার বিভাগের ষষ্ঠ পর্বের (অকৃতকার্য) নাঈম ইসলাম, ২০১৬-১৭ সেশনের ইলেকট্রনিকস বিভাগের সপ্তম পর্বের প্লাবন কুমার কুণ্ডু, মেকাট্রনিকস সপ্তম পর্বের মেহেদী মাহমুদ, মেকানিক্যাল বিভাগের সপ্তম পর্বের মেহদি হাসান, ২০১৭-১৮ সেশনের ইলেকট্রনিকস বিভাগের পঞ্চম পর্বের ওমর আজিজ, ২০১৮-১৯ সেশনের তৃতীয় পর্বের কম্পিউটার বিভাগের মাহবুবুর রহমান ও পাওয়ার বিভাগের তৃতীয় পর্বের মাসুদ রানা মীম।
শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজশাহী পলিটেকনিকে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ও পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ।
মিডটার্মে ফেল ও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা দুই শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিনকে চাপ দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে গত ২ নভেম্বর কার্যালয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে তাঁদের কথা কাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে ওই দিন দুপুরে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার পর টেনে হিঁচড়ে ক্যাম্পাসের ভেতরের একটি পুকুরের পানিতে ফেলে দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে মামলা করেন অধ্যক্ষ। এতে সাতজনের নাম উল্লেখসহ ৫০ জনকে আসামি করা হয়।
অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় ওই সময় ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাম প্রশাসনিক পরিষদের সভায় তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মুস্তাফিজুর রহমান তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ওই সভায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে কার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে নিশ্চিত করেন ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি চলমান রেখে সুষ্ঠুভাবে একাডেমিক কার্যক্রম চালানো অসম্ভব। এ কারণে আগামী পাঁচ বছর এখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ছাত্রলীগের টর্চারসেল হিসেবে পরিচিত ১১১৯ নম্বর কক্ষটি ভেঙে ছাত্র কমনরুম বৃদ্ধিরও সুপারিশ করা হয়েছে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সভার এসব সিদ্ধান্ত কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এসব সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। তবে তিনি জানান, বর্তমানে এখানকার শিক্ষার পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিনা পোশাকে কাউকে ক্যাম্পাসে প্রবেশের বিষয়েও কঠোরতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, মামলাটি প্রথমে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ তদন্ত করছিল। পরে সেটি ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুব হাসান জানান, ঘটনার মূল হোতা সৌরভসহ এজাহারভুক্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া এজাহারের বাইরে থাকা আরো ১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। মামলাটির তদন্ত চলছে। অন্য অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।