মেলায় কয়েদিদের পণ্যে আগ্রহী ক্রেতা

Looks like you've blocked notifications!

আদালতের নির্দেশে সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া কয়েদিরা বিভিন্ন কাজ করে সময় পার করেন। তাঁদের মধ্যে কিছু কয়েদি বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, সুতা ও কাঠ দিয়ে বিভিন্ন নান্দনিক পণ্য তৈরি করেন। তৈরির পর তা বিক্রিও করে কারা কর্তৃপক্ষ। জেল থেকে কয়েদিদের তৈরি করা এসব পণ্য এবার বাণিজ্য মেলায় নিয়ে এসেছে কারা কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বিক্রি নিয়ে আমরা অনেক সন্তুষ্ট। আমাদের পণ্যগুলো মানুষ খুবই আগ্রহ নিয়ে কিনছে।’

কেন্দ্রীয় কারাগারসহ মোট ২৬টি কারাগার থেকে অন্তত ২০০ রকমের পণ্য ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় নিয়ে এসেছে কারা কর্তৃপক্ষ। নান্দনিক এসব পণ্যের দামও অনেক কম। কয়েদিদের তৈরি বলে পণ্যের চাহিদাও অনেক। ক্রেতারা কিনছেনও বেশ।

বিক্রির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের বেড ঝাড়ু, দাম ৭০ টাকা। দ্বিতীয় তালিকায় আছে বাঁশ ও বেতের তৈরি মোড়া, দাম ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকা।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে বাণিজ্য মেলার ৩ নম্বর প্যাভিলিয়নে বাংলাদেশ জেল কারা পণ্যের দোকানে গিয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দেখা যায়, ক্রেতারা খুবই আগ্রহ নিয়ে কিনেছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্য। কেনার সময় কয়েদিরা কীভাবে জেলের ভেতরে এসব পণ্য তৈরি করেন, তাও শুনতে চাচ্ছেন ক্রেতারা। বিক্রেতারা সবাই কোনো না কোনো কারাগারের কর্মকর্তা। তাঁরাও মন খুলে এসব পণ্য তৈরির কাহিনী জানান দিচ্ছেন ক্রেতাদের কাছে।

নাসিমা আক্তার নামের এক নারী বেড ঝাড়ু আর পাপোশ কিনেছেন। তিনি একজন বিক্রেতার কাছে জানতে চান এসব পণ্যের ইতিহাস। বিক্রেতা সব বললেন। তখন তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আরো অনেক কিছু কিনতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এতকিছু নিয়ে মেলায় ঘুরা মুশকিল। সন্ধ্যার পর যখন মেলা থেকে চলে যাব, তখন হয়তো আবার আসব। খুব ভালো লাগল শুনে যে, আমাদের কয়েদিরাও বসে নেই। তারাও রাষ্ট্রের জন্য অবদান রাখছেন। জেলে বসেও নিজেরা আয় করছেন।’

কবির হোসেন নামের একজন সিংহাসন চেয়ার কিনবেন বলে দরদাম করছেন। দাম দুই হাজার ২০০ টাকা। তিনি বলেন, ‘এত সুন্দর করে প্লাস্টিক দিয়ে বানানো যায়, এটা না দেখলে বুঝতাম না। খুব পছন্দ হয়েছে, তবে এখন বেশি টাকা নেই। কাল একবার এসে একটা চেয়ার নিয়ে যাব।’

বাংলাদেশ জেল কারা পণ্য স্টলের প্রধান কর্মকর্তা খন্দকার মো. মোশারফ হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মোট ২৬টি কারাগারের ২০০টির বেশি পণ্য আমরা এখানে এনেছি। এসব পণ্য সব সশ্রম কারাদণ্ড পাওয়া কয়েদিরা তৈরি করেছেন। তবে দু-একজন সাধারণ কয়েদিও স্বেচ্ছায় এসব কাজ করে থাকেন। বিক্রি হওয়া পণ্যের অর্ধেক লভ্যাংশ কয়েদিদের দেওয়া হয়। সেই অর্থ তাঁরা পরিবারের জন্যও পাঠাতে পারেন। জেলে বসে বানানো কয়েদিদের তৈরি করা এসব পণ্য এবার বাণিজ্য মেলায় অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে।’

খন্দকার মো. মোশারফ আরো বলেন, ‘যে কয়েদিরা এসব পণ্য তৈরি করছেন, তাঁদেরই কিন্তু লাভ হচ্ছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁরা এই কাজ করেও কিন্তু জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। এ ছাড়া তাঁরা জেলে থেকে অযাচিত সময় নষ্ট না করে কাজ করছেন, এতে তাঁদের মানসিক অবস্থাও ভালো থাকে। এদিকে আবার তাঁদের কাজের জন্য রাষ্ট্রও লাভবান হচ্ছে। অন্য দোকানের চেয়ে আমাদের পণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করছি আমরা। আমাদের পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ দেখে খুবই ভালো লাগছে। প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি হচ্ছে।’

পুরো স্টলটিতে মোট ২৮ জন স্টাফ বিক্রির কাজ করছেন। তাঁরা সবাই সারা দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন এসেছেন ঢাকা মহিলা কারাগার থেকে। নাম নূর নাহার। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে বেড ঝাড়ু। দাম মাত্র ৭০ টাকা হলেও নান্দনিক এই পণ্য মানুষের নজর কেড়েছে। এ ছাড়া বাঁশ, বেত ও প্লাস্টিকের মোড়ার প্রচুর চাহিদা রয়েছে।’

জানতে চাইলে নূর নাহার আরো বলেন, ‘এসব পণ্য তৈরির জন্য প্রথমে কয়েদিদের সব ধরনের সরঞ্জাম দেওয়া হয়। তারপর তাঁরা এসব পণ্য তৈরি করেন। আসামিদের মধ্য থেকে একজন পুরো টিমের দায়িত্বে থাকেন। তাঁদের মনিটর করার জন্য আবার আমাদের জেল কর্তৃপক্ষ সব সময় তৎপর। বলা তো যায় না, যদি কখনো তাঁরা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। তবে এসব পণ্য তৈরি করে কয়েদিদেরই লাভ হচ্ছে। সাজার অংশ হিসেবে কাজের সঙ্গে সঙ্গে বেনিফিট কিন্তু পাচ্ছে। আর তাদের তৈরি এসব পণ্য মেলায় বেশ বিক্রিও হচ্ছে।’

পুরো দোকান ঘুরে দেখা যায়, পুঁতি, তাঁত, পাট, বাঁশ, বেত, কাঠ ও প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য তাঁদের প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে। বাঁশ ও বেতের তৈরি প্রতিটি মোড়া ৬০০ থেকে ৮৫০ টাকা, সিংহাসন চেয়ার আড়াই হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা, কুলা ও চালনি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা, ফুল ও ফলের ঝুড়ি ১০০ থেকে ২৫০ টাকা, পানদানি, কলমদানি ও ফুড কভার আকার ভেদে ৩০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। নারীদের জন্য ভ্যানিটি ব্যাগ ৬০০ টাকা, পুঁতির পার্স ব্যাগ ৩০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে উলেন গেঞ্জি ও টি-শার্ট, নকশিকাঁথা আড়াই হাজার থেকে চার হাজার, বুটিক ও বাটিকের থ্রিপিস ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, গামছা ও লুঙ্গি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং বেডশিট এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, হস্তশিল্পের পুঁতি দানার ব্যাগ, নৌকা, ফুলদানি, টিসু বক্স, শোপিসসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে এই প্যাভিলিয়নে। কয়েদিদের বানানো কাঠের তৈরি খাট ২২ হাজার টাকা, আলমারি ও ওয়ার্ডরোব ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং ড্রেসিং টেবিল ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।