আসছে ডাক বিভাগের নগদ, অর্থ লেনদেনের অতিরিক্ত সীমা অপব্যবহারের আশঙ্কা
অর্থ লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ ডাক বিভাগ নিয়ে আসছে নতুন ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’। বিদ্যমান মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের মতো ‘নগদ’ একটি সেবা হলেও এর দৈনিক ও মাসিক লেনদেনের অতিরিক্ত সীমা নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এতে মানি লন্ডারিং ও অপরাধমূলক কার্যক্রমে অর্থায়নের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলেও মনে করছেন আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি একই ধরনের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বলে মনে করেন তাঁরা।
জানা গেছে, নগদের মাধ্যমে একজন গ্রাহক দিনে ১০ বারে আড়াই লাখ টাকা জমা এবং সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। আর মাসে ৫০ বারে পাঁচ লাখ টাকা ক্যাশ ইন-আউট করতে পারবেন। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জন্য সুপরিচিত বিকাশ বা রকেটের একজন গ্রাহক দিনে দুবারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা জমা এবং ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। এ ছাড়া মাসে সর্বোচ্চ ২০ বারে এক লাখ টাকা জমা এবং মাসে সর্বোচ্চ ১০ বারে ৫০ হাজার টাকা টাকা ক্যাশ-আউট তথা উত্তোলন করতে পারবেন। সুতরাং বিদ্যমান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের তুলনায় জমার ক্ষেত্রে ২৫ গুণ এবং উত্তোলনে ১৭ গুণ বেশি লেনদেনের সুযোগ পাবেন ডাক বিভাগের গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, গত আগস্ট মাসে 'নগদ' সেবা চালুর অনুমোদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে ডাক বিভাগ। তখন তাদের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ব্যাংক-কোম্পানি আইনের আওতায় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ডাক বিভাগ পরিচালিত হয় নিজস্ব আইনের (পোস্টাল অ্যাক্ট) আওতায়। আইনি এ জটিলতার কারণে তাদের আবেদন নাকচ করা হয়। এখন নিজস্ব আইন অনুযায়ী সেবাটি চালু করতে যাচ্ছে ডাক বিভাগ।
মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, মাদক চোরাচালানসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের সীমা কমিয়ে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস খুব কম সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও কিছু অসাধু ব্যক্তি এসব সেবার অপব্যবহার করছে, যা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। এ পরিপ্রেক্ষিতে অপব্যবহার রোধ এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে লেনদেন সীমা কমানো হলো।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ডাক বিভাগ নগদ নামে সে ডিজিটাল অর্থিক সেবা নিয়ে আসছে, সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে নয়। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সরকারের সংস্থাগুলো অনুমোদন দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করেছে বলেই আমার মনে হয়। যেহেতু জঙ্গি তৎপরতার ঝুঁকির কথা ভেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, সেহেতু তারা এই বিষয়টি ভেবে দেখেছে বলে আমার ধারণা।’
অন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘নগদ’-এর অতিরিক্ত আর্থিক লেনদেনের সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। নগদ-এর কারণে তারা বৈষম্যের শিকার হবে কি-না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেখুন, এটা একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাঁরা নগদকে নিয়ে পরিকল্পনা করার সময় নিশ্চয়ই এ বিষয়গুলো ভেবে দেখেছেন। আপাতদৃষ্টিতে এখানে একটি বৈষম্য সৃষ্টি হবে। তবুও বলব, আগে শুরু হোক, তারপর দেখা যাবে।’ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবার লেনদেনের হার বাড়ানো হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপাতত সেই চিন্তা নেই। দেখা যাক, সামনে কেমন সার্ভিস দেয় নগদ। যদি তাদের ভেতরে বড় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগী হবে বলে আমার মনে হয়। লেটস সি।’
এ প্রসঙ্গে বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আট বছর ধরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস খাত সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনায় বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও আমাদের মতো সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা ও বিনিয়োগের স্বার্থ সুরক্ষায় নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতা এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা আব্যশক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডাক বিভাগের ‘নগদ’-এর সেবার ধরন একই রকম। কিন্তু তাদের মধ্যে লেনদেনের সীমার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হলে বিকাশ, রকেটের মতো যে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসগুলো আছে, সেগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই উদ্যোগী হওয়া উচিত। এ ছাড়া অতিরিক্ত মাত্রায় এই অর্থিক লেনদেনের সুবিধা মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ডিজিটাল আর্থিক সেবা নগদ বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অধীনে চলবে। তবে হঠাৎ করে শুরু হতে যাওয়া এই ডিজিটাল আর্থিক সেবার অর্থিক লেনদেনের মাত্রটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা ডাক বিভাগের আরো ভেবে দেখা দরকার। আর মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসগুলো যদি মনে করে তাদের অর্থ লিমিটেশনটা শিথিল করা দরকার, তাহলে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ করতে পারে।’
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুশান্ত কে মণ্ডল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এটি তো মোবাইল ব্যাংকিং নয়, এটি ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস। যদিও এটি বিকাশ বা রকেটের মতোই একটি সেবা। কিন্তু এতে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোর শঙ্কাবোধের কোনো কারণ নেই, তাদের ব্যবসায় কোনো ক্ষতি হবে না। এটি বাংলাদেশ পোস্টাল অ্যাক্ট অ্যামেন্ডমেন্ট-২০১০ অনুযায়ী পরিচালিত হবে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সার্ভিস ছিল দেশের প্রথম ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থাপনায় ডাক বিভাগের শত বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশব্যাপী নয় হাজার ৮৮৬টি ডাকঘর এবং কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবায় যেকোনো অনিয়ম দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে। এরই মধ্যে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ সেবা চালুর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মুনাফা ভাগাভাগির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশে এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে সেবা দেবে। ইতিমধ্যে এজেন্ট নিয়োগের কাজও শুরু হয়েছে।