‘খায়েস থাকলে ভোটে আসেন, জনগণ ক্ষমতায় বসালে দেশ চালাবেন’
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন; নির্বাচনের সময় (২০১৮ ও ২০২৩) ঢাকার প্রবেশমুখে বিএনপির সেই অবস্থান কর্মসূচিতে কি ঘটেছিল; নয়াবাজারে পুলিশ-ছাত্রলীগের হামলা, অতঃপর ডিবিতে হারুনের ‘হোটেলে’ ভাত খাওয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়াসহ নানা বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, বিএনপির সাংগঠনিক বিষয় ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট মাহমুদুল হাসান।
এনটিভি : গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে রাজপথে একাধিকবার হামলা শিকার হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ২৫ ডিসেম্বর এবং ২০২৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে আপনার ওপর হামলার ঘটনা কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : ১৯৬২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমি রাজনীতিতে অব্যাহতভাবে সক্রিয় আছি। কখনও সামনে, কখনও পেছনে, কখনও পাশে আছি। রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো পেশায় আত্মনিয়োগ করিনি। ৬৩ বছর রাজনীতি করার পর আমার মনে হয় এখনও রাজনীতি শিখতে পারিনি। আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। প্রতিটা রাজনৈতিক পরিবর্তন, পরিবর্ধনের পরে কতগুলো প্রতিক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে। আমার ওপর হামলা হয়েছে। গণতন্ত্রবিহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা-পরায়ণ।
গণতন্ত্র মানে বহু মত, অনেক মতের মধ্যে একটা পথে আসতে পারা— এটাই হলো রাজনীতি। আমার দেশের গণতন্ত্র, আমার দেশের স্বার্থ, আমার দেশের মানবাধিকার, যে রাজনীতি করি, যে প্রক্রিয়াতেই করি— এই বিষয়গুলো প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও নেতার মধ্যে থাকা দরকার। রাজনীতিতে তর্ক-বিতর্ক থাকবে। আমাকে জনসভায় গালি দিয়েছে, তার মানে আমি তাকে একটি চড় দেব— বিষয়টা এরকম না। ওইরকম একটা জনসভা করে আবার এর জবাব দিতে হবে, বিকেলবেলা একসাথে বসে চা খাব। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকতে হবে ধৈর্য্য।
আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতার কথা যদি বলি, তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে ১৯ দফা নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হন। তিনি বললেন, কে কি বলল এটা বিষয় না, আমার ১৯ দফা নিয়ে আপনারা জনগণের সামনে হাজির হবেন। তাদের (তৎকালীন বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ) সাধারণ মানুষ কম্বল চোর হিসেবে চেনে। সুতরাং আমাদের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
স্বৈরাচার একটি ব্যক্তি না, একটি অপরাজনীতির পদ্ধতি। আমি তো করেছি পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন। স্বৈরাচারের প্রধান কে? এরশাদ (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। এ জন্য সে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বৈরাচার। আর শেখ হাসিনা ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসছে, তিনি হলেন অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচার। কিন্তু কনস্টিটিউশন অনুযায়ী আমি তাকে স্বৈরাচার বলতে পারতেছি না। চুরি করে আসুক আর যে করেই আসুক, ক্ষমতায় এসেছে। তাই তাঁর সর্বশেষ নামকরণ করা হলো ফ্যাসিষ্ট। ফ্যাসিজমের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, যেভাবে ক্ষমতায় এসেছে সেখানে গণতন্ত্র ছিল না।
এনটিভি : নয়াবাজারে আপনার ওপর হামলার ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : আমার দলের একটি কর্মসূচি ছিল, ওখানে স্বেচ্ছায় গিয়ে মার খাইনি। ঢাকা শহরের আরও কয়েকটি জায়গায় একই সময়ে কর্মসূচি ছিল। টঙ্গী, যাত্রাবাড়ী, বাবুবাজার। আমার মনে হয়, সবাই সবকটা স্পটে গিয়েছিল, পুলিশ তাদের পায় নাই। পুলিশ যদি তাদের পাইতো তাহলে সবাইকে রক্তাক্ত করত। আমি আমার কর্মীদের নিয়ে বাবুবাজার অভিমুখে নয়াবাজারে কর্মসূচি সফল করার চেষ্টা করেছি। ওখানে পুলিশ, ছাত্রলীগ, হেলমেট বাহিনী— যেটাই বলেন সবার হামলার শিকার আমি। তবুও আমরা কর্মসূচি সফল করার চেষ্টা করেছি। আমি জানতাম আমার ওপর আক্রমণ করবে, তারপরও যেতে হবে।

এনটিভি : ডিবি অফিসে খাওয়া প্রসঙ্গে কি বলবেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : এটা একেবারেই নোংরা নাটক। যাকেই পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হোক, তাকে অবশ্যই তার চিকিৎসা, খাওয়া-দাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। আমাকে নিয়ে গেছে ডিবিতে, আমাকে তো খাওয়াতে হবেই। পুলিশ কাস্টডিতে আমার তো নতুন অভিজ্ঞতা না, আরও তো অনেকেই গিয়েছে। আমি একটা রুটি ও একটু ভাজি খাই, এর চেয়ে বেশি তো খাই না।
জেলে যাওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা আছে। সবাই জানে, থানা হাজতে খাওয়া যায় না। ওখানে টাকা দিতে হয়, তারা খাবার কিনে এনে দেয়। কিন্তু ডিবি অফিসে ছবি তুলে যে বাইরে প্রচারটা করা হলো, এটার মধ্যদিয়ে তারা প্রমাণ করলো তারা কতটা নিম্নমানের লোক। সাধারণত খাবার টেবিলের ছবি তোলা হয় না, তোলে না কেউ। খাওয়ার ছবি কখনও প্রচারে আসে না। আরও কয়েকজন কয়েকবার গিয়েছিল, কারও খাবার তো প্রচারে আসেনি। আর সেসময় যে ধরনের খাবার সাজিয়ে রেখেছে, এর সোর্স অফ ফান্ড কোথা থেকে এসেছে? সাজিয়ে রেখে ছবি তুলে দেওয়ার তো একটা উদ্দেশ্য আছে। আমাকে তো ওখানে ভুরিভোজ করানোর জন্য দাওয়াত দেয়নি। যে কোয়ালিটির খাবার, এটা আমি ভুলেও খাই না। অনেক দামি খাবার, এটা ঠিক। আমার খাবারের একটা রুটিন আছে। সেটাই খাই। আমি অনেক বড় রেস্টুরেন্টে যাই, কর্মীদের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু খাই না।
এনটিভি : ওই হামলা পরিকল্পিত ছিল কিনা?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : শেখ হাসিনার কোনো কাজ অপরিকল্পিত ছিল না। আমার সামনে পুলিশ বাহিনী আছে বন্দুক তাক করে। এসব তোয়াক্কা না করে আমি সামনে এগিয়ে গিয়েছি। অন্য জায়গায় যারা ছিল তারা দেখছে নামা যাচ্ছে না, তারা সেই সেইফ সাইডে চলে গেছেন। আমাদের কর্মীদের একটা গুণ আছে, নেতাদের পাই না— এটা যেমন বলে, আবার নেতাদের হামলার মুখে পড়তে দেয় না। আমাকেও নেতাকর্মীরা চেষ্টা করেছে না নামতে। অন্যদেরও হয়তো বা চেষ্টা করেছে, নামবেন না। আর ওটা যে কত পরিকল্পিত নাটক, আমানউল্লাহ আমানকে মিরপুর থেকে ধরে নিয়ে গেল। হসপিটালে যেতে না যেতে এই শেখ হাসিনা ফুলের তোড়া আর খাবার পাঠাইলো। এখন নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। পুলিশ ধরলো, হাসিনার কি দায় পড়লো ওখানে খাবার পাঠাতে হবে, ফুল পাঠাতে হবে? আদর-যত্ন করার এত কি দরকার পড়লো? এসব সবাই যে বুঝে— এটা শেখ হাসিনা বুঝতো না। যার কারণে খেসারত দিতে হয়েছে।
সূত্রাপুর থানার ওসি ও ওয়ারী থানার ওসি আমার ওপর হামলার সময় ছিল। গত ৬ আগস্ট যেভাবে ঘেরাও করা হয়েছিল, আমি যদি না ফেরাইতাম, তাদের মাইরা ফালাইতো, যারা আমাকে মারলো। কর্মীরা কিন্তু ৬ তারিখেই থানা ঘেরাও করল। আমি নেতাকর্মীদের অনুরোধ করেছি। আমি যদি প্রতিহিংসার রাজনীতি করতাম তাহলে পুলিশের উপর অ্যাটাক হয়তো। পুলিশ থানার মধ্যে মারা যেত, লাশ পড়তো। আমি তো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমি প্রতিশোধ নেব, অবশ্যই প্রতিশোধ নেব। প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ এক নয়। গণতন্ত্রের জন্য আমি ১৭ বছর লড়াই করেছি। কারও বাড়ি দখল করার জন্য না। আমি গণতন্ত্র ফেরত আনার জন্য লড়াই করেছি। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব। এটাই তো বড় প্রতিশোধ। একেক জনের প্রতিশোধ একেক রকম। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিশোধটা আমি এভাবেই বলতে চাই।
এনটিভি : সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল কিনা? ঢাকার প্রবেশ মুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে কি বলবেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : সাংগঠনিক দুর্বলতা বা অব্যবস্থাপনার কথা বলব না। আমি যেখানে গিয়েছি আমার নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে কনভিন্স করে তাদের অর্গানাইজ করে গিয়েছি। অন্যরা হয়তোবা সরকার কি থেকে কি করবে তা বুঝে উঠতে পারেনি। সব লোক জড়ো হওয়ার আগেই কেউ গ্রেফতার হয়ে গেছে। কোনো নেতা সরে গেছে। সব জায়গায় লোক ছিল কিন্তু যিনি নেতৃত্ব দেবেন তারও তো দায়িত্ব ছিল ওই জায়গায় জড়ো করার। মোবাইলের মাধ্যমে এ পাশে না হোক ওই পাশে হবে। ওই পাশে না হয় অন্য পাশে। আমি এক জায়গায় কিছু লোক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, বাকিরা তো জানলো না। জানলে হয়তো আরও ৪০০-৫০০ লোক একসাথে জড়ো হতে পারতো।
এনটিভি : ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা যাইনি। তখন দায়িত্বে ছিলেন আমাদের ম্যাডাম (বেগম খালেদা জিয়া)। উনি চাননি নির্বাচনে যেতে, আমরা যাইনি। ফলাফল যাই হোক আন্তর্জাতিক মহলে একটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তারানকো (জাতিসংঘের তৎকালীন বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো) মধ্যস্থতা করতে ঢাকায় এসেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা এবং আমাদের দলের নেতারা মিটিং করেছে। শেখ হাসিনা ওয়াদা করেছিলেন, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা হিসেবে একটা নির্বাচন দিতে হবে। পরবর্তীতে দ্রুত সময়ের মধ্যে আবার একটা নির্বাচন হবে।
আমাদের পক্ষ থেকে যেসব নেতা মিটিং করেছেন তারা কিন্তু এ বিষয়টাকে পাবলিক করে নাই। তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমু— তাদের সামনে যদি পাবলিক করতো। প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম, এই নির্বাচনটা পরে কবে হবে? আমাদের মধ্যে একটা কনফিউশন তৈরি হলো। কিন্তু আমরা ম্যাডামের সামনে বলতাম না। নির্বাচনে না যাওয়াটা ভুল হয়েছে, আমাদের বাঘা বাঘা নেতারা এটা বলেছেন পরবর্তীতে। যখন ম্যাডামের সামনে মিটিংয়ে বসতো তখন ভুলেও এ কথা বলতো না।
ম্যাডামের অবর্তমানে (খালেদা জিয়া তখন কারাবন্দি) ২০১৮ সালের নির্বাচনে যাওয়ায় প্রমাণিত হলো খালেদা জিয়ার ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনের না গেলে এই প্রশ্নটা থেকে যেত আমার দলের মধ্যে, বড় বড় নেতাদের মধ্যে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে কেন গেলাম— এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে? ম্যাডাম জেলখানায়, দায়িত্বে এলো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সুদূর লন্ডনে। সরকার আমাদেরকে বা কাউকে কিছুটা কনফিউজড করেছে, কিছু টোপ দিয়েছে। ম্যাডামের অনুপস্থিতিতে ৯৫ শতাংশ নেতাকর্মীর মধ্যে যখন নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না আওয়াজ এলো, তখন কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে, নাম নাই বললাম। সেই নির্বাচন বয়কট করলে দলে ভাঙন হতে পারে, আবার দলের নিবন্ধন বাতিল করে দিতে পারে। নানা কথা...।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার পরে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মূল নেতৃত্বে। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং প্রশ্ন তোলার সুযোগটা না দিয়ে বাধ্য হয়েছি নির্বাচনে যেতে। যেসব বড় বড় নেতাকর্মী নির্বাচনে যেতে সাউন্ড করেছে তাদের মধ্যে একজন ছাড়া কেউ সিট পায়নি। হাসিনা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামিয়ে দিয়েছে। হাসিনা কাকে সিট দেবে না দেবে, ওটার তো তালিকা দেয়নি। সুতরাং যা হওয়ার তাই হয়েছে। মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) তাঁর নিজের এলাকায় পাশ করেননি, বগুড়া থেকে পাস করেছেন। নীলনকশা সরকারের— এটা হয়তো আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছে, বুঝতে অক্ষম ছিলাম। আমি নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলাম, তবে প্রশ্ন যে তাহলে নির্বাচন করলেন কেন? তারেক রহমান মাত্র নেতৃত্বে এসেছেন। আমি যদি নির্বাচনে না যাই, স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে তাহলে তার নেতৃত্বকে অস্বীকার করা হবে, অপমান করা হবে। এ কারণে আমাকে নির্বাচনে অংশ নিতে হলো। সেই নির্বাচনে প্রচারণার সময় আমার ওপর হামলা হলো। ওইদিন ছুটির দিন ছিল বলেই আমি হাসপাতালে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। গোলাপ শাহ মাজারে যখন আসি তখন আমি হাত-পা ছেড়ে দিয়েছিলাম। হসপিটালে আমাকে অপারেশন করেছে, এনেস্থেসিয়া লাগেনি। স্যালাইন দিয়েছে, বিনা এনেস্থেসিয়ায় আমার মাথায় সেলাই করেছে। তারপর আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে।
এখন পত্রপত্রিকায় বলে— চাঁদাবাজি, দখলবাজি, এইটা-সেইটা। কিন্তু এটা বলে না যে আমরা কি পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয়েছি। কত মানুষ মা হারিয়েছে, সন্তান হারিয়েছে। এমনকি আমাদের যুবক ছেলেদের কতজনের বউ চলে গেছে। কারণ বছরের পর বছর সে বাইরে থাকবে— একটা মেয়ে কত ধৈর্য্য ধরবে, তাই না? এমন ঘটনা তো আছে, সেগুলোর তো মূল্যায়ন হচ্ছে না। এখন মনে হয় এরকম, আওয়ামী লীগ যা করছে তাদেরকে ফুলের মালা দিয়ে কোলাকুলি করে বরণ করে নাও, তাদের কোনো অপরাধ নাই। তারা যে চলে গেছে, তাদের কোনো অপরাধ নাই। তারা যে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে— এটা কোনো অপরাধ না। হাজার হাজার মানুষ যে খুন করছে করেছে— এটার কোনো প্রতিক্রিয়া নাই। মানুষ গুম করেছে, এখনও তাদের পাওয়া যায়নি। এগুলো নিয়ে কিন্তু কথা নেই। কথা এই দখল ওই দখল, দোকান দখল করেছে, বাড়ি দখল করেছে, জায়গা দখল করেছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। তারা (আওয়ামী লীগ) এতদিন ভোগ করেছে, এখন আমি আমার জায়গাটা যখন পুনরুদ্ধার করেছি— আমি দখলবাজি করছি। তার মানে আওয়ামী লীগ যা যা নিছে, তার মধ্যে হাত দেওয়া যাবে না। আইনগতভাবে কাগজপত্র যখন বলে, সম্পত্তি আমার। আমি যখন নেই তখন বলা হয়নি যে অমুক দখল করেছে, তার (বিএনপির নেতাকর্মীদের) জায়গা দখল করেছে, কোনো আওয়ামী লীগার জায়গা দখল করেছে।
এনটিভি : বিএনপি তো অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারের পার্লামেন্টে দাঁড়াইয়া ওবায়দুল কাদের ও তোফায়েল আহমেদ বলে, সরকার পতন হলে এক রাতে ২ লাখ লোক মারা যাবে। আওয়ামী লীগের দুইটা লোক মারা গেছে? বিএনপির হাতে এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা দেখান। আওয়ামী লীগে তো ভাবতে পারেনি, ক্ষমতাচ্যুতির পর তারা এত সুখে আছে। হ্যাঁ, আতঙ্কে আছে। কিন্তু সুখে তো আছে। শেখ হাসিনাকে যারা সমর্থন দিয়েছে, যে লুটেরা গোষ্ঠী ছিল, তাদের কয়টা লোকের বিচার হয়েছে? কয়টা পত্রিকায় তাদের নিয়ে লেখা হয়েছে?
এনটিভি : সংবিধান অনুযায়ী কোন প্রক্রিয়া নির্বাচন হতে পারে?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : কথা হলো, অনেকেই তো বলে, অন্তর্বর্তী সরকার আজীবন দরকার, উনার আরও থাকা দরকার। সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে না। আমরা তো সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি, আমরা কিন্তু সরকার পতনের পরে দিইনি, দুই বছর আগেই দিয়েছি। যুগপৎ আন্দোলনের সকল রাজনৈতিক দল মিলে আমরা সংস্কার প্রস্তাব করেছি। হাসিনা সরকার যদি স্বাভাবিকভাবে পদত্যাগ করতো, তাহলে একটা সরকার গঠন হতো। সেই সরকার নির্বাচন করত। সেই সরকার গঠনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনে কমিশনের যেহেতু বাধ্যবাধকতা আছে, তাহলে এখন নির্বাচন কমিশনের পাঁচ বছর, ১০ বছর লাগবে কেন? কেন তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারবে না? হাসিনার সংশোধিত সংবিধানে যতটুকু নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আছে ততটুকু ক্ষমতা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।
সংবিধান সংস্কার মুখে বললেই তো হবে না। একটি নির্বাচিত পার্লামেন্ট করতে হবে। সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য আশা যায়। পরবর্তীতে পার্লামেন্টে সংযোজন-বিযোজন করার যেতে পারে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল যদি সংস্কারে বিশ্বাস করে তাহলে তারা একটি নৈতিক সমর্থন দিতে পারে। সংস্কারে ঐকমত্য পোষণ করে নির্বাচন করলে টেকসই হবে।
এনটিভি : নির্বাচন কবে হবে?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নির্বাচন কবে হবে? উত্তর তো এখন দিতে পারব না। সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে না— অনেক কথা বলা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক দল হয়েছে। নতুন দলকে স্বাগত জানাই। শতফুল ফুটতে দাও। জনগণ যে দেশের মালিক— এটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। ভোটের মাধ্যমে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নির্বাচনটা দিতে হবে, ভাসা ভাসা কথা দিয়ে কাজ হবে না। প্রধান উপদেষ্টা বলবে একটা, তার উপদেষ্টারা বলবে আরেকটা, পাবলিক কার কথা বিশ্বাস করবে?
এনটিভি : যখনই নির্বাচন হবে, আপনারা জোটগতভাবে অংশ নেবেন কি?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : এই প্রশ্নটা করার সময় আছে। আমার উত্তর দেওয়ার সময় হয়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বলে দেবে জোটগতভাবে নির্বাচনে যাব কিনা?
এনটিভি : বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরছেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : আমার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, আমাদের নেতা তারেক রহমান। তারা যদি আজকে চিৎকার দিয়ে বলে, আমার ১৭টি বছর ফেরত দাও। শরীরে আঘাতে চিহ্ন। এর জবাব কে দেবে? তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আছে, অনেকেই অনেক কথা বলেন। খায়েস থাকলে ভোটে আসেন, জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসালে দেশ চালাবেন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
এনটিভি : দেশবাসী ও নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কী বলবেন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নেতাকর্মীদের বলব, রাজনীতি করতে হলে ধৈর্য্য থাকতে হবে। আগামী দিনে ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।