ব্যবসায়ী শাহ আলম হত্যা : ছেলে ও তার প্রেমিকার যাবজ্জীবন
রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার জনশক্তি ব্যবসায়ী শাহ আলম হত্যা মামলায় তাঁর ছেলে সৈকত হোসেন রাজ ও তার প্রেমিকা লাবণীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসাথে লাশ গুম করার ঘটনায় উভয়কে সাত বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সপ্তম অতিরিক্ত আদালতের বিচারক তেহসিন ইফতেখার আজ মঙ্গলবার (৩০ মে) এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, আসামিরা দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অপরাধ করে সর্বোচ্চ শাস্তি পাবার যোগ্য; কিন্তু তাদের বয়স কম হওয়ায় এবং নিহত শাহ আলম তাঁর ছেলের সামনে তাঁর প্রেমিকার সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া, যা ঘৃণিত কাজ। এসব বিবেচনায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির পরিবর্তে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হলো।
এ সময় মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী হযরত আলী এবং অ্যাডিশনাল পিপি মাহাবুবুর রহমান, এপিপি হুমায়ুন কবির চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
অ্যাডিশনাল পিপি মাহাবুবুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। আদালত সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যোগ্য বলে মনে করেছেন। তবে আসামিদের বয়স বিবেচনায় যাবজ্জীবন কারদণ্ড দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি।
অপরদিকে আইনজীবী হযরত আলী বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চআদালতে আপিল করবো।
মামলার নথিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল বাদী বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন, সবুজবাগ থানা এলাকায় একটি অটোরিকশাতে লাগেজের মধ্যে মৃত একজনের দেহ পড়ে আছে। এরপরে লাগেজ খুলে দেখেন অজ্ঞাত ৫৭ বছরের এক পুরুষ ব্যক্তির মৃতদেহ। হাঁটুমোরা অবস্থায় গলায় সবুজ রঙের প্লাস্টিক ও পাটের রশি দিয়ে প্যাঁচানো। উলঙ্গ মৃতদেহের উপরে কালো রঙের বোরকা দেখে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। স্থানীয়ভাবে জানতে পারেন যে, ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল রাত ৮টার সময় ২১ বছরের অজ্ঞাত মহিলা বনশ্রীর দিকে থেকে সিএনজি নিয়ে চালক মুজিবুর রহমান লাগেজসহ সোনারগাঁও থানার নয়পুর যাওয়ার কথা বলে উক্ত সিএনজি ড্রাইভার অপর সিএনজি চালক রহিম ও বাদলের সহায়তায় অপর একটি অজ্ঞাত সিএনজি হতে লাগেজ নামিয়ে উপরোক্ত সিএনজিতে উঠিয়ে অজ্ঞাতনামা মহিলা বলেন, লাগেজের মধ্যে কাচের জিনিস আছে সাবধানে নাড়াচারা করতে হবে। সিএনজিচালক নন্দীপাড়া সেতুমুখী ছিলিলি গার্মেন্টসের কাছে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়লে মহিলা পানি কেনার কথা বলে সিএনজি থেকে নেমে দৌড়ে বনশ্রীর দিকে পালিয়ে যায়। পরে সিএনজিচালকের সন্দেহ হলে লাগেজের চেইন খুলে দেখেন একটি মৃত মানুষের মাথা দেখা যায়। পরে থানায় সংবাদ দিলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। মামলাটি তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক আরিফুর রহমান আদালতে দুজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। এরপর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলার বিচার চলাকালে আদালত সাতজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
মামলার চার্জশিটে হত্যার বর্ণনায় বলা হয়, ছোটবেলায় লাবণী হোসেন ইমুর (২১) বাবা মারা যায়। পরে তার মা অন্যত্র বিয়ে করে ফেলে। লাবণীরা তিন বোন এক ভাই। তারা দাদির কাছে থাকত। খিলগাঁও তালতলা একটি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তার দাদি একটি মোবাইলফোন কিনে দেয়। মোবাইলফোন নষ্ট হয়ে গেলে দোকানে ঠিক করতে গিয়ে দোকানদার সৈকত হোসেন রাজের সাথে লাবণীর পরিচয় হয়। সেই সুবাদে তাদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন রাজ বন্ধুর বাসায় পার্টি আছে বলে লাবণীকে নিয়ে যায়। সেখানে নাচ গান শেষে লাবণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয়। এরপর থেকে তাদের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট হয়। সৈকত হোসেন রাজের বোন মিলি লাবণীর সাথে পড়াশুনা করতো। সেই সুবাদে মিলির সাথে রাজদের বাসায় গিয়ে জানতে পারে, রাজের স্ত্রী রয়েছে। পরে লাবণী রাগ করে বাসায় চলে আসে। রাজের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় লাবণী। কিন্তু রাজ তাকে বিদেশ যেতে না দিয়ে বলে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাকে বিয়ে করবে। এই বলে তারা ঢাকার বাইরে চলে যায়। পরে একদিন রাজের বাসায় রাজের ছোট বোন পলির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে রাতে থেকে যায় লাবণী। সেখানে এক পর্যায়ে রাজের বাবা শাহ আলম লাবণীর সাথে পরিচয় করে মোবাইলফোন নম্বর নিয়ে যায়। এ সময় লাবণীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত দেয় নিহত শাহ আলম। এ ঘটনা লাবণী রাজকে জানালে দুজনে তাঁর বাবাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক রাজের বাবা শাহ আলমকে লাবণী ফোন দিয়ে তাঁর বাসায় আসতে বলে। রাজ লাবণীর খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। রাজের বাবা বাসায় আসার পর লাবণীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিয়ে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় লাবণী তাকে থামিয়ে পানীয়র সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে বেহুশ করে ফেলে। পরে রাজ ও লাবণী রশি দিয়ে শাহ আলমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে লাশ বড় লাগেজের ভেতরে ঢুকিয়ে সিএনজিযোগে লাবণী রাস্তায় রেখে পালিয়ে যায়।