অতিরিক্ত ভ্যাট, তার ওপর চাঁদাবাজি!
ঢাকা দক্ষিণের অতিরিক্ত ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ আলী মণ্ডলের বিরুদ্ধে ভ্যাট আদায়ের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন মুন্সীগঞ্জের একাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁদের অভিযোগ, ভ্যাট কমিশনার নিয়ম বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় করছেন এবং চাঁদাবাজি করছেন।
অতিরিক্ত ভ্যাট ও চাঁদা দিতে না পারায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব কারখানা চালু আছে সেগুলোও যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন কারখানার মালিকরা।
এদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। এতে এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পঞ্চসার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান (ইউপি) গোলাম মোস্তফা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের সদর উপজের পঞ্চসার ইউনিয়নের বিসিক শিল্প নগরীতে প্রায় ১০০ কারখানা আছে। এসব কারখানায় বিভিন্ন ধরনের জাল (ফনোফিলামেন্ট, মালটি, নটলেস ও ঝড়া), কটন সুতা, পাতা গাছি রশি (প্লাস্টিকের দড়ি) তৈরি করা হয়। এসব কারখানার আশপাশে আরো প্রায় ২০০ কারখানা আছে। কারখানাগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে নিবন্ধন নিয়েছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ের অধীন। চার মাস আগে ঢাকা দক্ষিণের ভ্যাট কমিশনার এলাকার তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিক শিল্প কারখানার বেশ কয়েকজন মালিক জানান, সম্প্রতি এনবিআর ভ্যাট বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার পরপর অতিরিক্ত ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ আলী মণ্ডল বেপরোয়া হয়ে পড়েন। তিনি পঞ্চসারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঢুকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাঁর দপ্তরে নিয়ে যান এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায় এবং তাঁকে পার্সেন্টেজ (চাঁদা) দিতে বলেন। শুধু তাই নয় উৎপাদিত পণ্য পথে বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছেন। এ অবস্থায় কিছু কিছু মালিক ও কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ওই কর্মকর্তার ইচ্ছে মতো কাজ করে যাচ্ছেন। আর যারা অতিরিক্ত টাকা দিতে অনিচ্ছুক তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলেন, ভ্যাট বৃদ্ধির বিষয়টি এখনো সুরাহা হয়নি। এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগে সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলাপচারিতা চলছে। এ অবস্থায় কী করে ওই কর্মকর্তা নির্ধারিত ফি থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় ও হয়রানির করছেন ব্যবসায়ীদের?
পঞ্চসারের বিসিক শিল্পনগরীর প্রতিষ্ঠান রানা ফিশিং নেটের স্বত্বাধিকারী মো. আমির হোসেন বলেন, ‘ভ্যাট কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মণ্ডল গত ২৫ অক্টোবর আমার কারখানায় প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যান এবং আমাকে অফিসে দেখা করতে বলেন। পরের দিন ভ্যাট কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি ভ্যাট বাবদ ব্যাংকে বছরে এক লাখ টাকা ও তাঁকে এক লাখ টাকা করে দিতে বলেন। কিন্তু আমার প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনকৃত এবং প্রতি বছর ১০ হাজার টাকা করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে আসছি। এ কথা বললে তিনি আমার ওপর চটে যান। তখন আমি কাগজপত্র রেখেই চলে আসি। এখন আমার কারখানা বন্ধ। শ্রমিকরা কর্মহীন।’
নয়াগাঁও এলাকার মাসুম ফিশিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. মাসুম বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধনকৃত। আমার কারখানার উৎপাদিত পণ্যের ওপর প্রতি বছর ভ্যাট ধার্য ছিল ২০ হাজার টাকা। কিন্তু হঠাৎ ভ্যাট কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মণ্ডল সরকারি কোষাগারে দুই লাখ টাকা ও তাঁকে তিন লাখ টাকা দিতে বলেন। কোনো উপায় না পেয়ে তাঁর সঙ্গে মিল করে কারখানা চালাচ্ছি।’
অন্য ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, আগে সরকার যেখানে বছরে ১০ হাজার টাকা ভ্যাট নিয়েছে এখন ২০ হাজার বা ২৫ হাজার টাকা ধার্য করলেও প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হবে না। কিন্তু ভ্যাট কর্মকর্তা যেভাবে ভ্যাটের নামে চাঁদাবাজি করছেন, এতে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ আলী মণ্ডল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘গত অর্থ বছর বিসিক শিল্প নগরী ও আশপাশের এলাকা থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছিল। এবার আমি ৫২ লাখ টাকা ভ্যাট আদায় করেছি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা আমার ওপর ক্ষুব্ধ। তারা মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।’
যোগাযোগ করা হলে পঞ্চসার ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গত মাসে ঢাকা দক্ষিণের ভ্যাট কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান ও অন্যান্য কর্মকর্তাসহ আমাদের উপস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানার ব্যবসায়ীদের বৈঠক হয়। বৈঠকে উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানকে বছরে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকার ওপর ভ্যাট ধার্য করা হয়। কিন্তু মুন্সীগঞ্জে বর্তমান অতিরিক্ত ভ্যাট কমিশনার কোন প্রক্রিয়ায় ভ্যাট আদায় করছেন তা আমার বোধগম্য নয়। তাঁর কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানাগুলো প্রায় বন্ধের পথে। আর প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হলে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। শিল্প এলাকায় সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা। এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষের অতিসত্বর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’