ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে সুবহানের আপিল
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা মুহাম্মদ আবদুস সুবহান। আজ বুধবার বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আপিল করেন তাঁর আইনজীবীরা।
আপিল আবেদনের পর আবদুস সুবহানের আইনজীবী শিশির মনির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন, সে রায় পর্যালোচনা করে আমরা অনেক ভুলত্রুটি পেয়েছি। ভুলত্রুটিগুলো খণ্ডন করতে ৯২টি যুক্তি উপস্থাপন করে আপিল করা হয়েছে। আপিল আবেদনটি ১১৮২ পৃষ্ঠার।’
আবদুস সুবহানের এই আইনজীবী আরো বলেন, ‘মাওলানা আবদুস সুবহান ১৯৭১-এর ঘটনার সময় যে জায়গায় অপরাধকার্য সংগঠিত করেছিলেন, সে জায়গাটি প্রসিকিউশন পরিদর্শন করেছেন বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ওই জায়গায় গিয়ে জানতে পারি, ৪০ বছর আগেই নদীভাঙনের সঙ্গে জায়গাটি বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া যাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বয়স স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দুই থেকে চার বছরের মধ্যে ছিল। এত ছোট শিশু প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারে না। অথচ ট্রাইব্যুনাল এদের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। আমরা আশা করি, আপিল বিভাগে আমরা ন্যায়বিচার পাব এবং মাওলানা আবদুস সুবহান খালাস পাবেন।’
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তাঁর বিরুদ্ধে আনা নয়টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একটিতে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। তিনটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সুবহানের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করেন।
মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩১ জন সাক্ষ্য দেন। আর আসামিপক্ষ হাজির করে একজন সাফাই সাক্ষী। ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধুর সেতুর পূর্ব পাশ থেকে আবদুস সুবহানকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পর ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর জামিন চেয়ে আবেদন করেন জামায়াতের এই নেতা। তবে ২ অক্টোবর জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২ অক্টোবর থেকে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়।
শুরুতে আবদুস সুবহানের মামলা ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন থাকলেও ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটিকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বাড়ি পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লায়। তিনি মৃত নঈমুদ্দিনের ছেলে। তাঁর ভালো নাম আবুল বসর মিয়া হলেও এলাকায় তিনি ‘মাওলানা সুবহান’ নামে পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাবনা জেলায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন আবদুস সুবহান। তিনি পাবনা জেলা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও কেন্দ্রীয় জামায়াতের শূরা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে পাবনা পিস কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন।
আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈশ্বরদী জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া স্বাধীনতাকামী মানুষকে বিহারিদের সহায়তায় হত্যা করা, ১৩ এপ্রিল ঈশ্বরদীর যুক্তিতলা গ্রামে লুটপাট ও পাঁচজনকে হত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া, ২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিয়ে সাহাপুর গ্রামে বাড়িঘর লুটপাট ও কয়েকজনকে হত্যা, ১২ মে সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিন-চারশ মানুষকে হত্যা।