বোরহানউদ্দিনের ঘটনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র : হাইকোর্ট
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঘটনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। এই ঘটনার পেছনে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ জন্য প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে।
বোরহানউদ্দিনে গতকাল রোববার একটি বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে এক আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আজ সোমবার এ মন্তব্য করেন।
বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) ব্যারিস্টার এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
এর আগে গতকাল রোববার মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কটূক্তির অভিযোগে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে বোরহানউদ্দিনে চলা বিক্ষোভ সমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন নিহত হন। আহত হয় কয়েকশ। এ নিয়ে আজ বিভিন্ন পত্রিকায় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী রবিউল ইসলাম। এ সময় তিনি ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে বলেন, ‘পুলিশের গুলিতেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আর এই ঘটনার তদন্ত পুলিশ করলে তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। এ বিষয়ে আদালত স্বতপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিতে পারেন।’
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে, তদন্ত চলছে। সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। মানুষ মারা গেছে, জনগণের পাশাপাশি পুলিশও গুরুতর আহত হয়েছে।’
আদালত আরো বলেন, ‘ফেসবুক আইডি হ্যাক করে পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পুলিশ। এ বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ হলে তখন আমাদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে ডিএজি ব্যারিস্টার এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোলার হতাহতের ঘটনায় প্রশাসন কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ, মামলা দায়ের ও তদন্তাধীন থাকায় আদালত এ মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করবে না। পরিস্থিতির সুযোগ যেন কেউ নিতে না পারে, এ ব্যাপারে প্রশাসনকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আদালত।’
ভোলার পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ১৮ অক্টোবর বোরহানউদ্দিনে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডি হ্যাক করে মেসেঞ্জারে ধর্মীয় অবমাননাকর বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর বিষয়টি তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ বিপ্লব চন্দ্রকে তাঁদের হেফাজতে আটক করে রাখে। বিপ্লবের আইডিটি হ্যাক করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে আটক করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার সকালে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে মুসল্লিরা বিপ্লবের ফাঁসির দাবিতে বোরহানউদ্দিনের ঈদগাহ মাদ্রাসার মাঠে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। পুলিশ এই সমাবেশের অনুমতি দেয়নি এবং জনতাকে অনুরোধ করে সমাবেশ না করার জন্য। তারপর হাজারো জনতা সেখানে জড়ো হয়। এবং সেখানে উত্তেজিত মুসল্লিরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। আক্রমণকারীদের গুলিতে পুলিশের দুই সদস্য আহত হন।
পুলিশ আরো জানায়, একপর্যায়ে আত্মরক্ষার্থে ও সরকারি জানমাল রক্ষার্থে ও উত্তেজিত লোকজনকে নিবৃত্ত করতে প্রথমে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে এবং পরে শটগান চালায় পুলিশ। পরে পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এ সময় বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান পাটওয়ারী (৪৫), বোরহানউদ্দিন উপজেলার মহিউদ্দিন পাটওয়ারীর ছেলে মাহবুব পাটওয়ারী (১৪), মনপুরা হাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান (৪০) ও বোরহানউদ্দিনের মো. শাহিন নামে চারজন নিহত হন। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ অনেক লোককে আটক করে।
বোরহানউদ্দিন উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে মুসল্লিদের দফায় দফায় সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনায় নতুন করে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ’। পাশাপাশি সংগঠনটির ব্যানারে আজকে ভোলা সরকারি বালক বিদ্যালয় মাঠে ডাকা সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে।
যদিও ভোলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাসুদ আলম সিদ্দিক দুপুরে এনটিভি অনলাইনকে বলেছেন, ‘আজ সোমবার সকাল থেকে ভোলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেহেতু ভোলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না, তাই আমাদের অনুমতি না নিয়ে কেউ সভা-সমাবেশ করতে পারবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
‘পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে’ বলেও জানান ডিসি সিদ্দিক।
এদিকে, গতকাল রোববার চারজন নিহতের ঘটনায় ভোলা সদর ও বোরহানউদ্দিন উপজেলা সদরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আজ সোমবার সকাল থেকে এ দুই স্থানেই বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে, এ জন্য সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন তাঁরা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ সকাল থেকে ভোলার সব অভ্যন্তরীণ পথে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন জেলা বাস মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম।
বাস মালিক সমিতির নেতা আরো বলেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মূলত যাত্রী, চালক, পরিবহন শ্রমিক ও যানবাহনের নিরাপত্তার কথা ভেবেই বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।’
বোরহানউদ্দিনের চারজন নিহতের প্রতিবাদে আজ সকালে ভোলা সদরে সমাবেশ আহ্বান করেছিল ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ’। কিন্তু পুলিশ এই সমাবেশে অনুমতি দেয়নি। সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে দুপুর ১২টার দিকে ঐক্য পরিষদের নেতারা ভোলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় পরিষদের আহ্বায়ক মাওলানা বশির আহমেদ ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
এতে বলা হয়, চারজন নিহতের প্রতিবাদে আগামীকাল মঙ্গলবার জেলার থানায় থানায় সমাবেশ এবং আগামী বৃহস্পতিবার জেলা সদরে সমাবেশ করা হবে। এ ছাড়া শুক্রবার নিহতদের স্মরণে দোয়া ও মোনাজাত ও শোক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় সেখানে ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা তাজ উদ্দিন ফারুকী, মাওলানা মিজানুর রহমান, মাওলানা আতাউর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ শেষে একটি বিশাল মিছিল জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
সংবাদ সম্মেলনে নেতারা বলেন, যদি তিন দিনের মধ্যে তাঁদের দাবি মানা না হয়, তাহলে তাঁরা তাঁদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
এদিকে আজ সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভোলা জেলা সদরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। বোরহানউদ্দিনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপক সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা না ঘটে।
গতকাল রোববার দুপুরে নিহত চারজনের দাফন রাতেই সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে মাহফুজুর রহমান পাটওয়ারীর জানাজা গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় বোরহানউদ্দিন উত্তরমাথা বাসস্ট্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদের জানাজা নিজ নিজ গ্রামে হয়। পরে তাঁদের দাফন করা হয় বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।