হলের করিডরে আসা-যাওয়ার পথে আসামিদের দেখা গেছে!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি মো. মোয়াজ আবু হুরায়রা ও শামীম বিল্লাহকে পাঁচ দিন করে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। আজ রোববার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ এ আদেশ দেন।
বিকেল ৩টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবরার হত্যার আসামি মো. মোয়াজ আবু হুরায়রা ও শামীম বিল্লাহকে হাজির করে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এরপর তাদের পক্ষে আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন খান (হিরণ) শুনানিতে বলেন, মাননীয় আদালত আবরার হত্যা মামলা দেশবাসীর বিবেককে নাড়া দিয়েছে। বিশ্ব তাকিয়ে আছে এ মামলার কী বিচার হয়। আসামিরা এজাহারভুক্ত। আবরার মেধাবী ছাত্র। বুয়েট থেকে বিশ্বমানের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর বাবা-মায়ের মুখ উজ্জল করবেন। কিন্তু বিনা কারণে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হোক।
অপরদিকে আসামি শামীম বিল্লাহর আইনজীবী ফকির আব্দুল মজিদ শুনানিতে বলেন, বিজ্ঞ আদালত আসামি শামীম বিল্লাহর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তিনি পাশের রুম থেকে আসার পথে দ্বিতীয় ভিডিও ফুটেজে তাঁকে দেখা গেছে। এ মামলায় ঘটনাস্থল থেকে যারা গ্রেপ্তার হয়ে এবং স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে শামীমের বিরুদ্ধে তারা কিছু বলে নাই। এ ঘটনায় জাতি শোকাহত, মর্মাহত। আমরাও শোকাহত, মর্মাহত। মামলাটির তদন্ত চলছে। নিরপেক্ষ তদন্ত হয়ে আসুক। এ অবস্থায় শামীমের রিমান্ড বাতিলের প্রার্থনা করছি।
এই আইনজীবীর শুনানির পর আসামি মোয়াজের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ কামরুল হোসেন বলেন, আসামি বুয়েটের শিক্ষার্থী। হলের করিডরে আসা-যাওয়ার পথে তাকে দেখা গেছে। যে আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে তারা কেউ তার নাম বলেনি।
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরার ফাহাদকে নির্যাতনের পর পাঁজাকোলে করে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। আবরারকে ধরে ছিল মোয়াজ, তানিম ও জেমি। আর পেছনে পেছনে প্রায় সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। ছবি : সংগৃহীত
তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, রাত আড়াইটার সময় আসামিরা আসা-যাওয়া করছিল। তাদের এত পড়াশোনা? আসলে তারা সেখানে পাহারা দিচ্ছিল। পরে বিচারক প্রত্যেককে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন।
গত রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় পরের দিন ৭ অক্টোবর আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ চকবাজার থানায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। সে রাতেই বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ ১১ জনকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ৬ অক্টোবর রাত ৮টা ১৩ মিনিট থেকে ৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত শেরেবাংলা হলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, রাত ৮টা ১৩ মিনিটে মো. শাদাত, তানিম, বিল্লাহ, অভি ও সাইফুল মিলে আবরার ফাহাদকে নিয়ে নিচতলার করিডর দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। পরে ৯টা ৭ মিনিটে অনিক সরকার, মো. মেহেদী হাসান রবিন ও মেফতাহুল ইসলাম জিয়নকে দোতলায় উঠতে দেখা যায়। তার মিনিটখানেক পরই যায় মুজাহিদ।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, আবরার ফাহাদকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বড় ভাইরা ডাকছে বলে তাঁকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায়।
এরপর দোতলার করিডরের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, রাত ১১টা ৭ ও ১০ মিনিটে প্রথমে জেমি ও তোহাকে বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে নেমে যেতে দেখা যায়। পরক্ষণেই যায় রাফাত, মোরশেদ ও বিল্লাহ। তারপর নেমে যায় মাজেদ ও মনির। এরপর ১১টা ৩৯ মিনিটে অনিকসহ এদের সবাই আবার দোতলায় উঠে আসে। রাত ১২টা ২৩ মিনিটে দোতলায় উঠে ২০১১ নম্বর কক্ষের দিকে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু। সাড়ে ১২টায় ওই কক্ষের দিকে যায় মোয়াজ। ১২টা ৩৬ মিনিটে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে যায় বিটু (সেদিন সকালে গণমাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কথা বলে বিটু)। পরক্ষণেই সকাল, মুজাহিদ ও মনির নিচে যায়।
রাত ১টার দিকে রাফাত, মনির, সকাল, মোরশেদ, ইসমাইল, বিল্লাহ, মাজেদ, মোয়াজ, জেমি, মুজাহিদ, রবিন, তানভীর ও অজ্ঞাতপরিচয় আরো কয়েকজনকে করিডরে চলাফেরা করতে দেখা যায়।
এরপর ১টা ১৩ মিনিটে আবরার ফাহাদকে পাঁজাকোলে করে করিডর দিয়ে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। আবরারকে ধরে ছিল মোয়াজ, তানিম ও জেমি। আর পেছনে পেছনে প্রায় সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে।
পরে ২টা ৩৫ মিনিটে ২০০৫ নম্বর কক্ষ থেকে ফাহাদকে তোষকের ওপর রেখে সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গাটিতে রাখা হয়। জেমি, মোয়াজ, বিল্লাহ, তানিম, সাইফুল, মাজেদ ও আকাশ মিলে আবরারের নিথর দেহ নিচতলায় সিঁড়ির ওই জায়গায় রাখে। দেড়টা থেকে আড়াইটা, এই সময়টাতে প্রায় সবাইকেই কয়েকবার করে নিচতলা, দোতলার মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। প্রত্যেকের চেহারায় চিন্তার ছাপ।
রাত ৩টা ৫ মিনিটে সেখানে হাজির হন বুয়েটের চিকিৎসক ডা. মাশুক এলাহী। ছাত্ররা তৎক্ষণাৎ স্ট্রেচার নিয়ে আসে। চিকিৎসক আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন। এরও ২০ মিনিট পর ৩টা ২৫-এ হলের প্রাধ্যক্ষ ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ঘটনাস্থলে আসেন। একটি বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা আবরারের মরদেহ সামনে রেখে তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রাসেলকে কথা বলতে দেখা যায়। পরে হল প্রাধ্যক্ষ চাদর তুলে আবরারের শরীর দেখেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া অনিক সরকার।
বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি মো. মুয়াজ আবু হুরায়রা ও শামীম বিল্লাহকে আজ রোববার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ছবি : ফোকাস বাংলা
আসামি মুয়াজকে গতকাল রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। শামীম বিল্লাহকে গত শুক্রবার সাতক্ষীরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আজ পর্যন্ত ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনায় প্রথম ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় মামলার ৫ নম্বর আসামি বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। পরের দিন শুক্রবার মামলার ৭ নম্বর আসামি বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, শনিবার ৩ নম্বর আসামি ও বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার এবং আজ ৯ নম্বর আসামি মুজাহিদুর রহমান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
আবরার ফাহাদ রাব্বীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় রিমান্ডে থাকা ছাত্রলীগের পাঁচ নেতাকর্মীকে আজ কারাগারে হয়। আসামিরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, যুগ্ম সম্পাদক মুহতাসিম ফুয়াদ, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না এবং সদস্য মুনতাসির আল জেমি ও কর্মী খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর।