সাড়ে ৩৭ লাখ টাকার পর্দা দেখল তদন্ত কমিটি
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ (ফমেক) হাসপাতালে পর্দা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় দুর্নীতি যেন হাল সময়ের রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বালিশ কেনার দুর্নীতিকেও হার মানিয়েছে। রূপপুরে ছয় হাজার টাকায় বালিশ কেনা হয়েছিল আর এখানে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) পর্দা। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এসব পর্দা কেনা হলেও তা কাজে লাগছে না। কারণ, জনবলের অভাবে হাসপাতালের ১০ শয্যার আইসিইউ বিভাগই চালু হয়নি।
পর্দাসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশনায় পাঁচ সদস্যের একটি দল এখন ফরিদপুরে। তাঁরা গতকাল বুধবার সারা দিন ও আজ বৃহস্পতিবার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তদন্তকাজ করেন। তদন্ত দলে রয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন ও সহকারী পরিচালক ডা. শফিকুর রহমান এবং সারা দেশে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রো ইকুইপমেন্ট মেইনটেইন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) সহকারী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার নাশিদ রহমান।
এ সময় তারা ক্রয় করা পর্দা ও যন্ত্রপাতিগুলো দেখেন। ব্যবহার না করার কারণে অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে কেনা অনেক পর্দা ও যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তাঁরা জানান। এ ব্যাপারে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, ‘পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত দল ফরিদপুরে এসেছে। বুধবার তারা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও বৃহস্পতিবার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তদন্ত করে। আমি তাদের তদন্তের ব্যাপারে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করছি। যেহেতু আমার সময়ের ঘটনা এটি নয়, তারপরেও তারা যা যা আমাদের কাছে চাচ্ছে, আমি সেই সব তথ্য দিয়ে তাদের সাহায্য করছি।’
দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শহিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে দুদকের পক্ষ থেকে এই তদন্তে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বহুল আলোচিত পর্দা ব্যবহার না হওয়া ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা দুই জায়গায় ঘুরে দেখেছি। ঢাকায় গিয়ে এ ব্যাপারে রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।’
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনায় অনিয়ম এবং আর্থিক ঘাপলা হয়েছে অভিমত ব্যক্ত করে হাইকোর্ট দুদককে এ বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলে। ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ৫১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিভিন্ন ধরনের ১৬৬টি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। অনিক ট্রেডার্স ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিল পেলেও ১০ কোটি টাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানোসহ বিভিন্ন অসংগতির কারণে আটকে দেয়। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ১ জুন অনিক ট্রেডার্স হাইকোর্টে একটি রিট করে। এ রিট করার পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অনিক ট্রেডার্সের সরবরাহ করা ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির একটি তালিকা চেয়ে পাঠান। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই ১০ কোটি টাকার বিপরীতে দামসহ ১০টি আইটেমের যন্ত্রপাতির একটি তালিকা দেন। আর তাতেই উঠে আসে মহাদুর্নীতির খবর।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম দেখছে তদন্ত প্রতিনিধি দল। ছবি : এনটিভি
এতে দেখা যায়, ফমেক হাসপাতালে আইসিইউ রোগীকে আড়াল করে রাখার একসেট পর্দার দাম পড়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের একেকটি স্টেথোস্কোপের জন্য খরচ করেছে এক লাখ সাড়ে ১২ হাজার টাকা করে। ১০ হাজার টাকার ডিজিটাল ব্লাডপ্রেশার মাপার মেশিন কেনা হয় ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। অব্যবহৃত আইসিইউর জন্য অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্টের দাম ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। খোদ জাপান থেকে আনলেও এটার খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টাকা।
বিআইএস মনিটরিং প্ল্যান্ট স্থাপনে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এমন প্ল্যান্ট স্থাপনে সর্বোচ্চ খরচ হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় ১৮৬ গুণ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স।