আবরার ঘুম থেকে উঠল ঠিকই, তবে আর পড়া হলো না
দিনভর পড়াশোনা করে সন্ধ্যায় ঘুমাতে যান বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে রাতেও পড়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। বিছানায় যাওয়ার আগে বন্ধু ও রুমমেট সৈকতকে আবরার বলেন, 'আমাকে ৯ টায় ডেকে দিস'। এটাই সৈকতের সঙ্গে আবরারের শেষ কথা। এই কথা বলেই ঘুমিয়ে যায় আবরার। তবে সন্ধ্যার পর থেকে পৌনে আটটা পর্যন্ত ঘুম হয় আবরারের।
পৌনে আটটার দিকে বুয়েটের মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মুনতাসিন আল জেমিসহ আরেকজন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে এসে ডেকে তোলে আবরারকে। আবরার ঘুম থেকে ওঠার পরেই জেমি বলে উঠেন, ‘উপরে ভাইরা তোকে ডাকে।’ এ কথা শুনে কিছুই না বলে চোখ-মুখ ডলতে ডলতে আবরার চলে যান তাদের সঙ্গে। প্রবেশ করেন ভবনের দ্বিতীয় তলার ২০১১ নম্বর কক্ষে।
২০১১ নম্বর কক্ষে যাওয়ার পর আবরারকে প্রথমে নানা রকম প্রশ্ন করেন হল ছাত্রলীগের নেতারা। রাত সাড়ে আটটার দিকে দ্বিতীয় তলার কক্ষে থাকা অনেক শিক্ষার্থীই আবরারের চিৎকার শুনেছেন। তবে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেনি যে, আবরারই ওই চিৎকার করেছিলেন। তাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা শুনে তারা বুঝেছেন যে, আবরারই চিৎকার করছিল তখন।
২০১১ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগের চারজন নেতা থাকতেন। ওই কক্ষেই হলের অন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের যাতায়াত ছিল সব সময়। শেরেবাংলা হলের ভেতরে এই কক্ষটিই ছিল 'টর্চার রুম' নামে পরিচিত। তবে এসব নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে ভয় পেত। কারণ, কেউ এসব নিয়ে কথা বললে তাকেও করা হত নির্যাতন। করা হত গালাগাল। এমনকি হল থেকেও বের করে দেওয়ার নজির আছে।
গতকাল সোমবার সারাদিনে এসব বিষয় নিয়ে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। তাঁদেরই একজন সৈকত। তিনি ফাহাদের রুমমেট ও বন্ধু। সৈকত এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ফাহাদ পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়ে। সামনে পরীক্ষা, ভীষণ চাপ পড়ালেখার। রাতে বেশি সময় পড়বে বলে সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছিল। ঘুমানোর আগে আমাকে বলেছিল, তাকে যেন রাত ৯টার সময় ডেকে দেই। আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে ডেকে দেব। ওটাই ছিল ফাহাদের সঙ্গে আমার শেষ কথা।'
সৈকত বলেন, 'এরপর জেমি এসে ফাহাদকে ঘুম থেকে ডাকল। ডাকার সময় বলল, 'ভাইরা তোকে ওপরে ডাকে।' রাত তখন প্রায় আটটা বাজে। ফাহাদ ঘুম থেকে উঠেই চোখ-মুখ ডলতে ডলতে উপরে উঠে গেল। ঘুমানো পরে আর ফাহাদের সাথে আমার কথা হয়নি। পড়ার জন্য ফাহাদ আর কখনো ঘুম থেকে ডাকতে বলবে না আমাকে। আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।'
আবরারের বন্ধু সৈকত আরো বলেন, 'ফাহাদ খুব ভালো ছেলে। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না। কোনো ধরনের বাজে কাজে সে সময় দিত না। ভীষণ ভাল ছাত্র সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল আর বুয়েট তিন স্থানেই সে চান্স পেয়েছিল। তবে রাতে কিসের যেন একটা চিৎকারের আওয়াজ পাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু বুঝিনি ফাহাদকে পেটানো হচ্ছে। এই ঘটনা শোনার পর সব কল্পনা করলাম। নিচে শব্দ আসার কারণ, ২০১১ নম্বর কক্ষটি ঠিক আমার মাথার ওপর।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই হলের শিক্ষার্থীরা জানান, ‘২০১১ নম্বর রুমে মদ আর ইয়াবা চলত। তারা যতক্ষণ জেগে থাকতো ততক্ষণ জোরে জোরে গান বাজাত। এসব নিয়ে আমাদের পড়ার ক্ষতি হয়। কিন্তু কিছু বললেই গালি দিত। আর মারধরের ভয় তো আছেই। তাই আমরা কিছু বলতাম না। একবার একজন গান বাজানো নিয়ে অভিযোগ দিয়েছিল, তাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।' অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ওই রুমে শেরে বাংলা হলের অনেক ছেলে মার খাইছে।’