ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী দুদকের কাজল, আদালতের ‘না’
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে লড়তে চাইলেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। তবে আদালতের আপত্তিতে এদিন তিনি সাক্ষীকে জেরা করতে পারেননি।
গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আ স সামশ জগলুল হোসেনের আদালতে এক সাক্ষীকে জেরা করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আসেন। তবে মামলার ওকালতনামায় আইনজীবী কাজলের নাম ও স্বাক্ষর না থাকায় বিচারক তাঁকে জেরা করার অনুমতি দেননি।
এ বিষয়ে ওসি মোয়াজ্জেমের প্রধান আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এ মামলায় সময় টেলিভিশনের প্রতিবেদক আতিয়ার হাওলাদার সজল সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হাজির হন। সাক্ষী আতিয়ার হাওলাদার হাজির হলে আইনজীবী তিনি জেরা শুরু করেন। জেরা চলমান অবস্থায় মোশাররফ হোসেন কাজল ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন।
তখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে অবশিষ্ট জেরা মোশাররফ হোসেন কাজল করবেন বলে ফারুক আহম্মেদ বিচারককে জানান। এরপর মোশাররফ হোসেন কাজল জেরা শুরু করতে গেলে বিচারক মোহাম্মদ আ স সামশ জগলুল হোসেন ওকালতনামায় (মামলা পরিচালনার ক্ষমতাপত্র) নাম ও স্বাক্ষর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করেন।
মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘আমি সিনিয়র হিসেবে এসেছি। আপনি অনুমতি দিলে জেরা করব।’
তখন বিচারক বলেন, ‘ওকালতনামায় আপনি স্বাক্ষর না করলে জেরা করার সুযোগ নেই। ওই সময় বিচারক এ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাও পড়ে শোনান।’
এরপর মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতকে বলেন, ‘সিনিয়র আইনজীবীরা ওকালতনামায় নাম না থাকলেও আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এটা নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্টেও হচ্ছে।’
তখন বিচারক বলেন, ‘জেরা করতে হলে আইন অনুযায়ী ওকালতনামায় আপনাকে স্বাক্ষর করতে হবে। আপনার মতো সিনিয়র এ মামলা পরিচালনায় আসলে আদালতও উপকৃত হবে। আপনি চাইলে এখনই আদালতের নথিতে যে ওকালতনামা দেওয়া আছে সেখানে স্বাক্ষর করে জেরা শুরু করতে পারেন।’
উত্তরে কাজল বিচারককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমি এভাবে এখন ওকালতনামায় স্বাক্ষর দেব না। আগামী তারিখে দেব। আপনি পারলে একটা সময় দিয়ে দিন।’ তখন বিচারক সময় দেওয়া যাবে না বলে জানান।
আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘এরপর আদালতে বলি, আমরা এভাবেই সিনিয়রদের মামলা পরিচালনায় নিয়ে যাই। সিনিয়র আসবে তাই আমি প্রস্তুতি নেইনি। আমার জ্ঞানে যা ছিল তা জেরা করেছি। আর পারব না। আপনি (বিচারক) সময় দিন। তখন বিচারক লিখিত সময় আবেদন নামঞ্জুর করে জেরা করতে বলেন।
কিন্তু ফারুক আহম্মেদ ‘আর কিছু বলার নেই’ বলে শেষ করে দেন। বিচারক সাক্ষী আতিয়ার হাওলাদারের সাক্ষ্য সমাপ্ত ঘোষণা করে আগামী ২ অক্টোবর পরবর্তী সাক্ষীকে জেরার জন্য দিন ধার্য করেন।
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম জানান, শুনানির সময় মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন আদালতে হাজির ছিলেন। এ ছাড়া কারাগারে থাকা ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গত ২ জুলাই হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। এর আগে ১৭ জুন তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর আগের দিন ১৬ জুন শাহবাগ এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে কারাগারে ডিভিশন পাওয়ার বিষয়ে আবেদন করা হলে বিচারক ২৪ জুন ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রথম শ্রেণির বন্দির (ডিভিশন) সব সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সোনাগাজী থানায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় এবং তাঁর জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ৩০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। একই দিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে একই ট্রাইব্যুনালের বিচারক সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে ১৭ জুন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বাদীসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী থানার চারজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, নুসরাত জাহান রাফির বয়স কম এবং তিনি একজন মাদ্রাসাছাত্রী। তাকে কয়েকজন পুরুষের সামনে শ্লীলতাহানির বক্তব্য শোনা এবং তা ভিডিওধারণ করা ন্যায়সঙ্গত নয়। নারী ও শিশুরা যেহেতু শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসেন, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন।
‘ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।’
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগী নুসরাতের মা। পরে সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর সোনাগাজী থানার ওসির কক্ষে ফের হয়রানির শিকার হতে হয় নুসরাতকে। নিয়ম না মেনে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তাঁর আইনজীবী ছিলেন না।
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগ মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
ওই দিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়।