প্রতিমা শিল্পীদের বিবর্ণ জীবন
প্রতিমা তৈরির প্রয়োজনীয় সব উপকরণের দাম বাড়ছে প্রতি বছর। কিন্তু ক্রেতারা প্রতিমা কিনতে চান কম টাকায়। এই টানাপড়েনে নানাভাবে খরচ কমিয়ে টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন প্রতিমা শিল্পীরা। কিন্তু সেটা কত দিন সম্ভব হবে?
শুক্ল পক্ষ শুরু হয়ে গেছে। কয়েক দিন পরই শুরু হবে দেবীপক্ষ। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। দেবী প্রতিমায় লেগেছে রঙের ছোঁয়া। কিন্তু বিবর্ণ মুখে প্রতিমা গড়ার কাজ করছেন শিল্পীরা। তাদের মনে ঝড় তুলছে এ প্রশ্ন- আর কয় বছর টিকে থাকা যাবে?
বাজারে উচ্চ মূল্যের তালিকায় যোগ হয়েছে প্রতিমা তৈরির বিভিন্ন উপকরণও। প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামের দাম বাড়ছে। বিপরীতে প্রতিমার বাজেট কমাতে চাইছে পূজার উদ্যোক্তরা।
প্রতিমা শিল্পীরা জানান, একে প্রতিমা তৈরি উপকরণের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, সেই হারে প্রতিমার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর ১০ হাজার টাকায় যে দুর্গা প্রতিমা বিক্রি হয়েছে, খরচ বাড়ায় এ বছর তা ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রভাব পড়েছে বাজারে।
প্রতিমার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পূজার উদ্যোক্তারা ঘুরছেন নানা জায়গায়। ফলে এ বছর প্রতিমা তৈরির উপকরণ কাপড়, খড়, মাটি, বাঁশ, রঙের খরচ বাড়লেও প্রতিমার তেমন দাম মিলছে না বলে জানান শিল্পীরা।
প্রতিমা শিল্পের সংকট শুধু একমুখী নয়। প্রতিমা তৈরিতে বড় জায়গার প্রয়োজন। শহরের এ রকম জায়গার পরিমাণ কমছে দিন দিন। সঙ্গে আছে কর্মী সংকট। এই শিল্পে বেশি পরিমাণে কাজ হয় শুধু দুর্গা পূজার আগে। তাই সারা বছরের জন্য জমি ও কর্মী পাওয়া খুবই কষ্টের।
চট্টগ্রাম মহানগরের সদরঘাটের কালিবাড়ির প্রতিমা কারিগর জয় নাথ জানান, তিনি ১০ বছর ধরে কাজ করছেন। কিন্তু কোনো বেতন বাড়েনি। আগের মতোই ১০ হাজার টাকা বেতন আছে। এর সঙ্গে কোনো বোনাসও পাওয়া যায় না। প্রতি মাসে ঠিকমতো বেতনও পাওয়া যায় না। এ কাজে এখন আর কেউ আসতে চায় না। সব কিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু তাদের কোনো গতি হলো না।
প্রতিমা শিল্পী সুশান্ত পাল বলেন, ‘বাবার সঙ্গে কাজ করতে এসেছি ২০ বছর হবে। প্রতিমা তৈরির জিনিসপত্রের দাম বেশি। আমাদের পরিবারের আর কেউ আসবে না এই শিল্পে। কর্মী দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাঁরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। তাই প্রতিমা বায়না নিয়ে সঠিক সময় দেওয়া নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয় অনেক সময়। আগে একজন শ্রমিক মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন। এখন তাঁরা দাবি করেন ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। অন্য পেশায় তাঁরা অনেক বেশি টাকা পাচ্ছেন বলে চলে যাচ্ছেন। কর্মী কম, তাই বায়না এলেও ফেরাতে হয়।
বোস গলির প্রতিমা শিল্পী বাসুদেব পাল প্রতিমা বানানোর কাজ করছেন ৫০ বছর ধরে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকার কত উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প নিচ্ছে। ক্ষুদ্র শিল্প বাঁচাতে কত কিছু করছে বলে পত্রিকায় পড়ি। কিন্তু এই দেশীয় শিল্পটা বাঁচাতে সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। সরকার যদি প্রতি বছর অন্তত স্বল্প মেয়াদি কিছু ঋণ দিত তাহলে এই শিল্পটা বাঁচত। প্রতিমা তৈরির জন্য এখন চট্টগ্রামে কোনো জায়গা পাওয়া যায় না। সিটি করপোরেশন যদি স্থায়ীভাবে একটি জমির ব্যবস্থা করে তাহলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ রক্ষা পাবে।
এদিকে পুলিশের চট্টগ্রামের রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, এবার বৃহত্তর চট্টগ্রামে সর্বমোট পূজামণ্ডপ তিন হাজার ৮২০টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি পূজা প্রায় এক হাজার ৬০০ মণ্ডপে। এ ছাড়া কক্সবাজারে ১৭০টি, কুমিল্লায় ৭৭০টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৫৭টি, চাঁদপুরে ১৯৯টি, ফেনীতে ১৪২টি, রাঙামাটিতে ৪৩টি, খাগড়াছড়িতে ৫৬টি ও বান্দরবানে ৭৮টি মণ্ডপে পূজা হবে। প্রতি পূজামণ্ডপে পুলিশের সঙ্গে আনসার সদস্য থাকবে। পাশাপাশি কয়েকটি পূজামণ্ডপ মিলে একটি পেট্রল টিম থাকবে। তারা ঘুরে ঘুরে পূজা মণ্ডপগুলো মনিটর করবে।