‘ক্যাসিনোতে এলে সবাই নিঃস্ব হয়ে ফেরে’
‘দুই মাস আগের ঘটনা। রাতে জুয়ার সেটে বসে প্রথমে দশ হাজার টাকা হেরে যাই। হাতে একটি আট আনা ওজনের স্বর্ণের আংটি ছিল। সেটাও এক জুয়াড়ির কাছে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেই। পরে ওই টাকাও হেরে যাই আমি। এখানে এলে সবাই নিঃস্ব হয়ে ফেরে।’
ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবটি আজ বৃহস্পতিবার সিলগালা করে দেয় র্যাব। মতিঝিলে ক্লাব প্রাঙ্গণের বাইরে তখন ছিল মানুষের ভিড়। ওই ভিড়েই ছিলেন মনোয়ার হোসেন (ছদ্মনাম)। এনটিভি অনলাইনকে তিনিই এসব কথা বলছিলেন। মনোয়ার নিয়মিত যেতেন ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোতে। আজ ক্লাবটির পরিণতি দেখতে দাঁড়িয়েছিলেন ভিড়ে।
দুপুর ১টার দিকে ক্লাবের সামনে গিয়ে দেখা গেল মানুষের ভিড়। ৯০-এর দশকেও ইয়ংমেন্স ক্লাবের সামনে এ রকম দৃশ্য দেখা যেত। ঢাকার ফুটবল তখন রমরমা। আবাহনী-মোহামেডান-ব্রাদার্সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলে আরো তিনটি ক্লাব; ইয়ংমেন্স, আরামবাগ ও রহমতগঞ্জ। শীর্ষ তিনটি দলের বুকে মাঝেমধ্যেই কাঁপন ধরিয়ে দিত ইয়ংমেন্স। কখনো জিতে যেত, কখনো ড্র করে থামিয়ে দিত বড় দলের জয়রথ।
সেই সোনালী দিন আর নেই। আজও ক্লাবটির সামনে ভিড়; কিন্তু তা ক্লাবটির জন্য লজ্জার বিষয়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ক্লাবটিতে অভিযান চালায় র্যাব। ক্যাসিনোর পাশাপাশি র্যাব উদ্ধার করে জুয়া খেলার সামগ্রী, মদ, নগদ টাকা।
ঠিক দুপুর দেড়টার দিকে ক্লাবের ফটকটি সিলগালা করে দেন র্যাব ৩-এর সদস্যরা। ক্লাব প্রাঙ্গণে সাতটি মোটরসাইকেল ছিল, সেগুলোও জব্দ করা হয়। দুপুর ২টার দিকে এলাকা ত্যাগ করে র্যাব সদস্যরা। তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও কৌতূহলী মানুষেরা তখনো এলাকা ছাড়েনি। বরং ক্লাবটি নিয়ে শুরু হয় কথাবার্তা।
‘প্রথমবার জুয়া খেলে এক লাখ টাকা হেরেছিলাম’
ওই সময়ই এই প্রতিবেদকের কথা হয় মনোয়ার হোসেনের। তিনি ঢাকারই বাসিন্দা। একসময় ওই ক্যাসিনোতে যেতেন তিনি। ক্যাসিনোতে অভিযান আর বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর শুনে ক্লাব প্রাঙ্গণে যান তিনি। র্যাবের সদস্যরা চলে গেলে ক্লাবটির ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান তিনি।
মনোয়ার বলেন, ‘তখন অনেক রাত। প্রচুর মদ খেয়ে আমার অবস্থা ভালো ছিল না। সিএনজি (সিএনজিচালিত অটোরিকশা) ভাড়া করার মতো টাকাও আমার কাছে ছিল না। তখন আমি এক বিদেশি নারীকে (ক্যাসিনো পরিচালনাকারী) বললাম আমার কাছে ভাড়ার টাকাও নেই। সে সময় তিনি ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, কত টাকা খেলেছি? বলার পর তিনি আমাকে বললেন,সিস্টেম নেই বস। ভাঙা-ভাঙা বাংলাতে তিনি এই কথা বলেন আমাকে।’
মনোয়ার আরো বলেন, ‘এরপর ওই রাতেই আমি টলতে টলতে হেঁটে বাসায় ফিরেছিলাম। যদিও বাসা বেশি দূরে ছিল না। তারপর থেকে আর কখনো জুয়া খেলিনি আমি। পণ করেছি আর কখনো খেলব না। প্রথমবার জুয়া খেলে এক লাখ টাকা হেরেছিলাম। প্রথমবার হারার কয়েকদিন পর আবার এসেছিলাম। এখানে (ক্যাসিনো) গেলে সবাই নিঃস্ব হয়ে ফেরে।’
‘কে ব্যবস্থা নেবে?’
ভিড়ের মধ্যে তখন অনেকেই নীরবতা ভাঙছেন। তখন অনেককে ক্যাসিনো ব্যবসার সমালোচনা করতে শোনা যায়। তবে গণমাধ্যমের পরিচয় দিলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্থানীয় দোকানদার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আর যেন কখনো এই ক্যাসিনো না চলে। স্থানীয় কিছু তরুণও এখানে এসে জুয়া খেলা শুরু করেছিল। এসব তো ভালো লক্ষণ না। আবার এসব নিয়ে আমরা সব জানলেও কথা বলি না। খুন হওয়ার কী দরকার আমার?’
ইয়ংমেনস ক্লাবের আশপাশেই আরিফ আহমেদের (ছদ্মনাম) বাড়ি। আরিফ বলেন, ‘এসব কে বন্ধ করবে? মতিঝিল থানার পেছনে এসব চলে। পুলিশ জানে না? সব জানে। কিন্তু কে ব্যবস্থা নেবে?’
আরিফ আরো বলেন, ‘একই স্থানে ছয়টি ক্যাসিনো। অথচ অভিযান চালানো হল দুটিতে। বাকিগুলোতে কি আর অভিযান চালানো হবে?’
আরিফের জানানো তথ্য অনুযায়ী বাকি চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোতে ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যেকটি ক্যাসিনোই বন্ধ। কেবল গেটের সামনে একজন বা দুইজন করে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। দারোয়ানেরাও প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। তবে দিলকুশা স্পোটিং ক্লাবের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা এক দারোয়ান নাম না জানিয়ে বলেন, ‘গতকাল বিকেল থেকে ক্লাব বন্ধ করা হয়েছে। কখন খুলবে তা আমি জানি না।’
এসব ক্যাসিনোর আশপাশের উপস্থিত থাকা সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় দোকানদারেরাও গণমাধ্যমে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে এদের ভেতরে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের পাশের এক দোকানদার নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমার কথা লিখে কি আমাকে বিপদে ফেলবেন? আমার বউ-বাচ্চা আছে না?’