অ্যাপে নয় খেপেই আগ্রহ, রাইড শেয়ারিংয়ের নতুন বিপদ
দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে অ্যাপস ভিত্তিক রাইডশেয়ারিং মোটরযান সেবা। মোটরসাইকেল, গাড়িভিত্তিক এ সেবা নগরবাসীর যেমন সুবিধা দিয়েছে তেমনি অসুবিধাও তৈরি করছে। বিশেষ করে রাইডশেয়ারিং হলেও এখন এটি চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশার মতো খেপে। সিএনজিচালক বা রিকশাচালক যেমন খেপের জন্য অপেক্ষা করে ঠিক তেমনি এসব রাইডারও যাত্রীর অপেক্ষায় ঢাকা শহরের মোড়ে মোড়ে অপেক্ষায় থাকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অ্যাপসভিত্তিক রাইডশেয়ারিং ‘উবার’, ‘পাঠাও’, ‘ও ভাই’, ‘সহজ’-এর রাইডাররা যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করে। তারা এসব পয়েন্ট দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষদের রিকশা ও সিএনজি চালিত অটোরিকশাচালকদের মতো ডেকে ডেকে বলে, ‘কোথায় যাবেন?’
শুধু রাইডাররা এমন করছে তা নয়! যাত্রীরাও মোটরসাইকেল দেখলেই হাত তুলে গাড়ি থামাতে ইশারা দেন। এতে যেমন বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি তেমনি দিন দিন বাড়ছে অপরাধ, আর হত্যার মতো ঘটনা। এরই মধ্যে ‘উবার’ ও ‘পাঠাও’-এর দুই চালক খুনের শিকার হয়েছেন খেপের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহন করতে গিয়ে।
যাত্রীদের অ্যাপসের বাইরে চুক্তিতে যাওয়ার প্রবণতা রাইডারদের আরো বেপরোয়া করে তুলছে। যাত্রীরা বেশি সময় অপেক্ষা না করে দ্রুত নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চান বলেই অ্যাপসে চেয়ে কেই প্রধান্য দেন। আর এসব কারণেই রাইডাররাও এখন আর অ্যাপে যেতে চায় না। তাদের অভিমত খেপে গেলে আয়ের ভাগ বা কমিশন দেওয়া লাগে না রাইড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে। আবার অ্যাপসের চেয়ে চুক্তিতে বেশি টাকায় যাত্রীকে গন্তব্যে পোঁছে দেওয়া যায়।
গত বুধবার রাতে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের সোনারগাঁ ট্রাফিক সিগন্যাল মোড়ে দেখা যায় মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন একাধিক ব্যক্তি। পথচারীদের দেখে তারা জানতে চান কোথায় যাবেন। আবার অনেক পথচারী নিজে থেকে এসে কথা বলছেন। গন্তব্যে গেলে কত টাকায় যাবে, তা নিয়ে চলে দর কষাকষি।
রাইডারদের এভাবে যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন রাইডারের কথা হয় এনটিভি অনলাইনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তারা জানায়, অ্যাপসের চেয়ে খেপে গেলে বেশি আয় করা যায়৷ আবার এ টাকার ভাগ দিতে হয় না প্রতিষ্ঠানকে। এটা সম্পূর্ণ নিজের থাকে। তা ছাড়া যাত্রীরাও বেশিরভাগ সময় অ্যাপসে রিকোয়েস্ট না দিয়ে খেপে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। তারাও চুক্তিভিত্তিক যাওয়ার বিষয়ে অধিক আগ্রহ দেখায়।
এভাবে গেলে নিরাপত্তার হুমকিসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। এর মাঝে দুই রাইডার হত্যার শিকার হয়েছেন। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে রাইড শেয়ারের বিষয়ে তারা বলেন, ‘সবাই চায় সহজ পথে সামনে যেতে৷ আর বিপদ জেনেও খেপে যাই কারণ বেশি টাকা আয়ের সুযোগ থাকে। তা ছাড়া যাত্রীদেরও আগ্রহ থাকে এভাবে যেতে।’
রাজধানীর বাংলমোটরে অপেক্ষা করছিলেন বেশ কিছু রাইডার। এ সময় বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এসে জানতে চান যাবেন কি না? তখন কোথায় যাবেন একসাথে বলে উঠেন কয়েকজন রাইডার। এর মধ্যে এক নারী ১৫০ টাকায় রাই্ডারের সঙ্গে চুক্তি করেন রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় যাওয়ার জন্য। অ্যাপস ব্যবহার না করে এভাবে চুক্তিতে কেন যাচ্ছেন জানতে চাইলে প্রথমে তিনি রেগে যান। পরে পরিচয় দেওয়ার পর এনটিভি অনলাইনের এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমার তাড়া আছে তাই যেতে হবে। তা ছাড়া অ্যাপসে রিকোয়েস্ট দিতে গেলে দেখা যাবে আশপাশে কোনো রাইড়ার নেই। যা কয়েকটা পাওয়া যাবে সেগুলো হয় যাবে না, অথবা দূরত্বে থাকবে অনেক। তাই উপায় না পেয়ে এভাবেই চুক্তিভিত্তিক যাচ্ছি।’
এই যাত্রীর কথার সত্যতাও পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে। বাংলামোটর মোড়ে অপেক্ষা করা রাইডাররা তাদের অ্যাপস বন্ধ করে রেখে চুক্তিভিত্তিক যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন।
এ দিকে ৫০ টাকায় খেপে যাত্রী পরিবহন করতে গিয়ে গত ২৫ আগস্ট রাত আড়াইটার দিকে মোটরসাইকেলের যাত্রীবেশি দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মো. মিলন (৩৫) নামের এক ‘পাঠাও’ চালক খুন হন। যাত্রীবেশে থাকা খুনি মিলনের গলা কেটে তার মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে পুলিশের তৎপরতায় প্রযুক্তির সহায়তায় চালক মিলনের খুনিকে শাহজাহানপুর এলাকা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।
মিলন রাতে রাজধানীতে নিজের মোটরসাইকেলে উবার ও পাঠাও-এর মাধ্যমে রাইড শেয়ার করতেন। তবে ৭ আগস্ট পর্যন্ত অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ারের তথ্য পাওয়া যায়। এরপর আর অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ারের রেকর্ড পাওয়া যায়নি। তবে তিনি চুক্তিতে যাত্রী নিতেন।
এর আগে চট্টগ্রামে এক উবার চালকের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন এক নারী। তিনিও অ্যাপসে না গিয়ে চুক্তিতে উবারে চড়ে বসেন। পরে নির্জন স্থানে গিয়ে উবার চালক তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় ওই নারীর অভিযোগের পর অভিযুক্ত চালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এভাবে গত কয়েক বছরে অনেক দুর্ঘটনা ও অপরাধ কাণ্ড ঘটেছে অ্যাপস ভিত্তিক এ সেবায়। এত কিছুর পরও দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে এ খাত। কিন্তু এ বিষয়ে যেন কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রশাসন যেমন নির্বিকার ঠিক তেমনি কোনো চোখে পড়ার মতো তদারকি নেই অ্যাপস ভিত্তিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের।
রাইডারদের নিজেদের ইচ্ছে মতো চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে পাঠাও-এর জনসংযোগ কর্মকর্তা নাবিলা এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘যখন আমাদের সাথে কোনো রাইডার যুক্ত হয় আমরা তাকে নিজের নিরাপত্তা ও যাত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টা নিশ্চিত করার বিষয়ে সতর্ক করে দেই। কিন্তু কেউ যদি নিজের নিরাপত্তার দিক বিবেচনা না করে তখন সেখানে আমরা কী করতে পারি?’
নাবিলা আরো বলেন, ‘একজন রাইডার যত সময় অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ার করবেন ততক্ষণ আমরা তাকে নজরদারি করতে পারি। কিন্তু তিনি যদি অ্যাপস বন্ধ করে দেন এবং কনটাক্টে যাত্রীসেবা দেন সে ক্ষেত্রে আসলে আমাদের কিছু করার নেই। অফলাইনে আপনি কোথায় আছেন সেটা জানা কারো পক্ষে সম্ভব না। তাই যাত্রী ও রাইডার সবাইকে সচেতন হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’