কাঁদছে মিলনের পরিবার, ‘খুনের বিচার পাব তো?’
বাসায় ঢুকতেই দেখা যায় সবাই কান্নাকাটি করছেন। কথা বললেন মিলনের বাবা আবুল কালাম (৬৫)। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু বিচার চাই, ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ এ কথা বলেই জ্ঞান হারান তিনি।
গত রোববার দিবাগত রাতে মোটরসাইকেলে যাত্রী নিয়ে মালিবাগ থেকে শান্তিনগরের দিকে যাচ্ছিলেন মো. মিলন। যাত্রী নিয়ে উড়াল সড়কে উঠার পর পরই মিলনকে ছুরিকাঘাত করে ওই যাত্রী। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি মারা যান। মিলনের মোটরসাইকেলটি ছিনতাই করে নিয়ে যায় যাত্রীবেশি ছিনতাইকারী।
মিলনের পরিবার থাকে মিরপুরের গুদারাঘাটের বটতলা মোড়ের আদর্শ টাওয়ারের পিছনের একটি ভবনের পাঁচতলায়। মঙ্গলবার দুপুরে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায় মিলনের মা-বাবা, স্ত্রী, পাঁচবোন সবাই কাঁদছেন। বোনেরা ওই এলাকাতেই থাকেন। মিলনের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম মিনহাজুল(১০) ও মেয়ের নাম সাদিয়া (৫)।
বাসায় গিয়ে বোঝা গেল মিলন ছিলেন তাঁদের প্রাণ। মিলনকে ঘিরেই ওই পরিবার।
আবুল কালাম জ্ঞান হারানোর পর ঘরের ভেতরে কান্না আরো বেড়ে যায়। হাতে-মুখে পানি দিয়েও জ্ঞান ফেরে না আবুল কালামের। এভাবে কিছু সময় পর জ্ঞান ফেরে তাঁর। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিলাপ করতে থাকেন। তখন তিনি বলেন, ‘আমার চশমা নষ্ট হয়ে গেছে। মিলন আমাকে সামনের শুক্রবার চশমা কিনে দিতে চেয়েছিল। এখন আমার চশমা কে কিনে দেবে? আমার ছেলে হত্যার বিচার পাব তো বাবা?’
সেখানে বসেছিলেন আবুল কালামের বড় মেয়ে ফারজানা আক্তার। বাবাকে উদ্দেশ করে তিনি তখন বলেন, ‘আমি শুক্রবারেই তোমার চশমা কিনে দেব আব্বা।’ বড় মেয়ের কথা শেষ না হতেই সবাই উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেন। এভাবে ছেলের কথা কেউ একবার তুললেই সবাই কেঁদে উঠছেন। তবে সবাই কাঁদলেও কাঁদছে না মিলনের ছেলে মিনহাজুল আর মেয়ে সাদিয়া। সবাই কাঁদে আর ওরা মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারালেন মিলনের বাবা আবুল কালাম। ছবি : সাইফুল সুমন
পানি নিয়ে গেল ঘর, ছিনতাইকারী নিয়ে গেল ছেলে!
আবুল কালাম গত ২০ বছর ধরে ঢাকায় আছেন। তিনি জানালেন ঢাকায় চারটি জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন তিনি। ঢাকার আসার আগে ছিলেন নোয়াখালীতে। ছেলের শোকে ঘরের ভেতরে আবুল কালামের বিলাপ করছেন। একটা সময় তিনি বলে উঠেন, ‘যখন নোয়াখালীর চরে ছিল বাড়ি। পানিতে নিয়ে গেছিল ঘর। ঘর যাওয়ার পর ঢাকাতে আইছিলাম। আর ঢাকায় এসে ছিনতাইকারী নিয়ে গেল আমার ছেলের প্রাণ।’
‘মেয়েকে দেখেও যেতে পারলাম না!’
ওই ঘরেই বসে ছিলেন মো. মিলনের স্ত্রী মোছা. শিল্পী। মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে তিনি বলেন, ‘ঈদের তিন দিন আগে থেকে রাতে গাড়ি (মোটরসাইকেল) নিয়ে বের হইত। এর আগে সব সময় দিনে গাড়ি চালাইত ওর বাবা। রোববার রাত ১০টার সময় মিলন ঘর থেকে বের হয়। তখন সে মেয়ে সাদিয়াকে খুঁজেছিল। কিন্তু মেয়ে ছিল দাদা-দাদির কাছে। দাদার কাছে ফোনও করেছিল মিলন। কিন্তু মেয়ে বলল, এখন আসবে না সে। যাওয়ার সময় মিলন বলে গেলেন, ‘মেয়েকে দেখেও যেতে পারলাম না!’
বিপদে এখন আর টাকা দেবে কে?
মিলনের মা ফাতেমা খাতুন (৫৫)। তিনি বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘টাকা পয়সার খুব দরকার হলেই ছেলে টাকা দিত। মিলন বড় ভাই। ওর ছোট পাঁচটা বোন আছে। ভাগনা-ভাগনিদের কত আবদার রাখত। টাকা দিত। এখন আর টাকা দেবে কে?’ কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরের ভেতরে থাকা সবাই কেঁদে উঠেন।
ছেলের কাছ থেকেই চশমা চান বাবা
মিলনের মা ফাতেমা খাতুনের কথা শেষ না হতেই বাবা আবুল কালাম বিছানা থেকে উঠতে যান। সে সময় তাঁর চোখ থেকে চশমা খুলে পড়ে যায়। মিলন বাবাকে কথা দিয়েছিলেন আগামী শুক্রবার নতুন চশমা কিনে দেবেন। সে কথা মনে পড়ায় আবুল কালাম আবারও বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলের কাছ থেকে চশমা নেব। ছেলে আমাকে চশমা কিনে দেবে।’
‘আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন সবাই’
মো. মিলনের বড় ছেলে মিনহাজুল। স্থানীয় একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। পুরো দু-ঘণ্টার ভেতরে একবারও কথা বলেনি মিনহাজুল। তবে শেষ সময়ে এই প্রতিবেদকের কাছে এসে মিনহাজুল বলে, ‘আব্বার জন্য কিছু করেন। সবাই আমার আব্বার জন্য দোয়া করবেন। আমার খুব কান্না পাচ্ছে।’