পোশাককর্মীকে হত্যার পর ১৫ টুকরো, স্বামী গ্রেপ্তার
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় পোশাককর্মী স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর ১৫ টুকরো করেছে বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি স্বামী। পুলিশ ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিহতের পাঁচ টুকরো মাংস পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় নিহতের স্বামী মামুন মিয়াকে (২৫) ঢাকার সাভারের কবিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ বুধবার বিকেলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার তাঁর কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন।
পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার জানান, নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার দেবকান্দা গ্রামের নিজাম উদ্দিনের মেয়ে সুমা আক্তার ওরফে সুমির (২৭) সঙ্গে প্রায় দুই বছর আগে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী ইউনিয়নের বরইবাড়ি এলাকার ফজলুল হকের ছেলে মামুন মিয়ার (২৫) বিয়ে হয়। এটি উভয়ের দ্বিতীয় বিয়ে। বর্তমান সংসারে কোনো সন্তানের জন্ম না হলেও তাঁদের উভয়ের আগের সংসারে একজন করে সন্তান রয়েছে। ওই দুই সন্তানের একজন তার দাদির কাছে এবং অপরজন তার নানির কাছে থাকে। বিয়ের পর সুমা তাঁর স্বামী মামুনকে নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গিলারচালা এলাকার শফিকুল ইসলামের বাড়িতে ভাড়া থেকে স্থানীয় সাবলাইম গ্রিনটেক নামের এক পোশাক কারখানার সুয়িং অপারেটর পদে চাকরি করতেন। মামুন ওই এলাকায় বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির কাজ করেন। বিয়ের কিছুদিন পর থেকে পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মামুন ও সুমার মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ চলে আসছিল। সম্প্রতি সুমার জমানো ৪০ হাজার টাকা ও মামুনের নারীঘটিত বিষয়াদি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ চরম আকার ধারণ করে।
পুলিশ সুপার জানান, ঈদের ছুটি কাটাতে গত শুক্রবার ৯ আগস্ট স্বামীকে নিয়ে নেত্রকোনা গ্রামের বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নেন সুমা। অপরদিকে আগের দিন স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মামুন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মামুন স্থানীয় বাজার থেকে দুটি ট্র্যাভেল ব্যাগ, একটি ছুরি, পলিথিন ও কিছু ঘুমের ওষুধ কেনেন। বাসায় যাওয়ার সময় মামুন হোটেল থেকে হালিম ও রুটি কিনে নেন। বাসায় ফিরে রাতে কৌশলে হালিম ও রুটির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে সুমাকে খাওয়ান। খাবার খেয়ে সুমা নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এরপর রাত ১টার দিকে বুকের ওপর বসে সুমার মুখ চেপে ধরে ও গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাঁকে হত্যা করেন স্বামী মামুন। পরে সুমার লাশ টেনে গোসলখানায় নিয়ে যান। সেখানে বাজার থেকে কিনে আনা স্টিলের ধারালো ছুরি দিয়ে প্রথমে মাথা, হাত ও পা বিচ্ছিন্ন করেন। পরে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে শুধু মাংস খণ্ড বিচ্ছিন্ন করেন। এভাবে সুমার লাশকে ১৫টি টুকরো করে ১০ কেজি ধারণক্ষম তিনটি পলিথিনে ভর্তি করে প্যাকেট করেন মামুন। শুক্রবার ভোরে দুই ’দফায় দু’টি প্যাকেটে ভর্তি লাশের ১০ টুকরো দু’টি ট্র্যাভেল ব্যাগে ভরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে পাশের কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী এলাকায় শীতলক্ষ্যার শাখা বানার নদীর সেতুতে নিয়ে যান। সেখানে লাশের টুকরো ভর্তি ব্যাগগুলো নদীতে ফেলে তৃতীয় প্যাকেট নেওয়ার জন্য পুনরায় বাসায় ফিরে আসেন মামুন। দুই দফায় ফেলে আসার মধ্যে মামুন স্থানীয় রুহুলের বাড়িতে বিদ্যুতের লাইন মেরামতের কাজ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করেন। পরে রাতে মামুন তাঁর শাশুড়িকে মোবাইল ফোন করে জানান, সুমাকে তিনি তাঁদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সুমা বাড়িতে পৌঁছেছে কি না এ সময় শাশুড়ির কাছে তাও জানতে চান মামুন।
এদিকে শুক্রবার রাতে সুমা বাড়ি না পৌঁছায় স্বজনরা তাঁর মোবাইলে ফোন করে বন্ধ পান। সুমার খোঁজ না পেয়ে পরদিন শনিবার সুমার ছোট বোন বৃষ্টি ও তাঁর (বৃষ্টির) স্বামী নবী হোসেন শ্রীপুরের গিলারচালায় আসেন। বড় বোন সুমার সঙ্গে বৃষ্টি একই কারখানায় চাকরি করেন। বৃষ্টি একই এলাকায় অন্যত্র ভাড়া থাকেন। সেখানে কাউকে না পেয়ে ঘরের দরজার তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে কারো খোঁজ পাননি। পরে পাশের এক বাড়ি থেকে মামুনকে পেয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সুমাদের বাসার উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। এ সময় মামুন কৌশলে পালিয়ে যান। সুমা ও মামুনের খোঁজ না পেয়ে বৃষ্টি ও তাঁর স্বামী গ্রামের বাড়ি ফিরে যান। তাঁরা বাড়ি গিয়ে সুমার খোঁজ না পেয়ে সোমবার ঈদুল আজহার দিন পুনরায় শ্রীপুরের ওই বাসায় আসেন এবং বাসার ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় তাঁরা ঘরের ভেতরে দুর্গন্ধ পান এবং ঘরে থাকা ড্রেসিং টেবিলের নিচে থেকে মেঝেতে রক্তাক্ত পানি গড়াতে দেখেন। রাত ৮টার দিকে ড্রেসিং টেবিলটির ড্রয়ার খুলে পলিথিনে মোড়ানো মানবদেহের মাংসের পাঁচটি টুকরা দেখতে পান তারা। তবে সেখানে মাথা, হাত ও পা ছিল না।
গাজীপুরে সুমা হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি। ছবি : এনটিভি
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ওই পাঁচ টুকরো মাংস উদ্ধার করে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
নিহতের বোন বৃষ্টি জানান, বৃহস্পতিবার বেতন দিয়ে কারখানায় ঈদের ছুটি হয়ে যায়। শুক্রবার তাঁদের সঙ্গে একত্রে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল সুমা’র। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সুমার জমানো ৪০ হাজার টাকা দিয়ে টিউবওয়েল স্থাপন ও বাড়ির বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করার কথা ছিল। শুক্রবার সকালে বাড়ি যাওয়ার সময় সুমাকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও না পেয়ে বৃষ্টি তাঁর স্বামীর সঙ্গে ময়মনসিংহে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। তাঁরা বাড়িতে পৌঁছে একাধিকবার বড় বোন ও ভগ্নিপতির মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাঁদের ফোন বন্ধ পেয়ে শ্রীপুরে সুমার বাসায় এসে মাংসের টুকরোর সন্ধান পান।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার ভোর রাতে পুলিশ ঢাকার আশুলিয়া থানাধীন কবিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ফুপাতো ভাইয়ের বাসা থেকে মামুনকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদকালে মামুন সুমাকে হত্যার কথা স্বীকার করে রোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন। এ সময় তিনি জানান, সুমার ৪০ হাজার টাকা নিয়ে একটি মোবাইল ফোন কিনেছেন তিনি। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ট্র্যাভেল ব্যাগ এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার করে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় দায়ের করেছেন।