হাত ধরাধরি করে বাঁচতে চেয়েছিল দুই শিশু
মা-বাবা তরে রাইখা চলে গেছে। এহন তুইও চইলা গেলি। আমার যে সবই শেষ হইয়া গেল। আমারে দেহার কেউ নাই, আমার কী সর্বনাশ হইয়া গেল। আমারে নিয়া গেল না ক্যান। আমি কী নিয়া বাঁচমু।
আজ রোববার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর পোস্তগোলার শ্মশানঘাটে গরু দেখতে এসে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে মারা যাওয়া শিশু শান্তর (১২) পাশে চিৎকার করে নানি ইয়ানুর বেগম এভাবে আহাজরি করে এনটিভি অনলাইনকে কথাগুলো বলছেন।
লাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ইয়ানুর বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, জুরাইনে তাদের বাসা। শান্ত সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে শ্মশানঘাটে গরু দেখতে যায়। দুপুরে আমারে একজনে ডাইকা বলে, শান্ত নদীতে পইড়া গেছে। দৌঁড়াইয়া আইছি। কিন্তু তারে আর জীবিত পাইলাম না।
ইয়ানুর বেগম বলেন, সাত বছর আগে শান্তর বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে যান। এরপর অন্য জায়গায় শান্তর মায়ে বিয়ে হয়ে যায়। আমার কাছে শান্ত থাকত। আমি (নানি) ছাড়া ওর আর কেউ ছিল না।
এ বিষয়ে ডুবুরি আবদুল কাইয়ুম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের ফোন দেওয়ার পর আমি দ্রুত চলে আসি। আসার সময় আরো একটি টিমকে ঘটনাস্থলে আসতেই বলি। আসার পরই উদ্ধার কাজ শুরু করি। একটি নমুনা ধরে অভিযান চালাই। একটা সময় দেখি কিছু একটা হাতে লাগছে। হাত দিয়ে ধরার পর বুঝতে পারি কোনো লাশ। প্রথম লাশটা হাতে রেখেই আশপাশি খুঁজি আর কোনো লাশ আছে কি না। কারণ শুনেছি পানিতে ডোবার সময় তারা (দুই শিশু) হাত ধরাধরি করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু কাছাকাছি কোনো লাশ পাইনি। একটি লাশ পানির ওপর নিয়ে আসি। প্রথম লাশটা ছিল শান্তর। এর ১০ মিনিট পরই একটু পাশে গিয়ে খোঁজার পর রিয়াদ (১১) নামের অপর শিশুর লাশ পেয়ে যাই।’
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, দুপুর ১২টার দিকে পোস্তগোলার শ্মশানঘাটে গরু দেখতে আসে জুরাইন এলাকার পাঁচ বন্ধু শান্ত, রিয়াদ, বাবলা, আকাশ ও রাসেল। ফরিদপুর থেকে ট্রলারে করে একের পর এক গরু নামে শ্মশানঘাটে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গরু দেখতে শত শত মানুষ ভিড় জমায় সেখানে।
সোয়া ১২টার দিকে এক শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। ছেলেটির নাম রাসেল। সে চিৎকার করে বলছে, আমার বন্ধু আর ভাগ্নে পানিতে ডুবে গেছে। এ সময় কয়েকজন দেখার চেষ্টা করে, পানিতে দেখা যায় কি না।
জিজ্ঞাসা করল কোথায় ডুবছে? কিন্তু কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। তবু রাসেল কাঁদছিল। এর কিছুক্ষণ পর এনটিভি অনলাইনের ফটোসাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সুমন এগিয়ে গেলে শিশুরা তাঁকে বিষয়টি জানায়। এরপর তিনি ডুবুরিকে ফোন দেওয়ার পর ১০ মিনিটেই ডুবুরির একটি দল আসে শ্মশানঘাটে। রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে ডুবুরিরা তল্লাশি শুরু করেন। নদীর কূল থেকে ২০ হাত দূরে শ্মশানঘাট এলাকায় দুপুর সোয়া ১টায় শান্ত ও ১টা ৪০ মিনিটে রিয়াদের লাশ পানি থেকে উদ্ধার করে ডুবুরি দল। ডুবুরি আবদুল কাইয়ুম একাই দুটি লাশ উদ্ধার করেন।
এ যেন জীবন্ত ঘুমিয়ে থাকা দুই শিশু! মাত্র এক ঘণ্টা আগেই তারা খেলছিল নদীরে কিনারে। এক ঘণ্টা পরই চলে গেল পরপারে! লাশ উদ্ধারের পর ভিড় জমতে থাকে শত শত মানুষ। শিশু শান্তর নানি ইয়ানুর বেগম ঘটনাস্থলে এলেও রিয়াদের পরিবারের কেউ খোঁজ পায়নি। বিকেল ৩টা পর্যন্ত তার পরিবারের কেউ আসেনি।