ব্যারিস্টার সুমনের মামলা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মোয়াজ্জেমের আইনজীবী
নুসরাত জাহান রাফির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যারিস্টার সাইয়্যেদুল হক সুমনের বিরুদ্ধে মামলা করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আসামিপক্ষ। জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম বলেছেন, ব্যারিস্টার সুমন মানবতার কারণেই মামলা করেছেন।
আজ বুধবার বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস সামশ জগলুল হোসেনের আদালতে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় তাঁর আইনজীবী ফারুক আহম্মেদের প্রশ্নের উত্তরে পিপি নজরুল ইসলাম শামীম এ কথা বলেন।
এদিন দুপুর ২টার দিকে কড়া পুলিশি পাহাড়ায় ওসি মোয়াজ্জেমকে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আদালতে হাজিরের পরই ওসি মোয়াজ্জেম তাঁর নিযুক্ত নতুন আইনজীবী ড. খন্দকার মোহাম্মদ মুশফিকুল হুদার সঙ্গে মামলার বিষয়ে একান্ত কথা বলেন। এরপর বিচারক এজলাসে উঠলে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ জামিনের আবেদন ও মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন।
বিচারক শুনানির অনুমতি দিলে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, মাননীয় আদালত ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে গেলে প্রথমেই সিআরপিসি (ফৌজদারি কার্যবিধি) দেখতে হবে। সিআরপিসির ১৯৮ ধারায় বলা আছে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ভিকটিমের আত্মীয়স্বজন আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলা করতে পারেন। এখানে ব্যারিস্টার সুমনের মামলা দায়েরের কোনো এখতিয়ার নেই। তিনি নুসরাতের পরিবারের কোনো সদস্য নন বা নুসরাতের পরিবার থেকে তাঁকে মামলা পরিচালনার কোনো অনুমতি বা দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
আইনজীবী বলেন, যে ভিডিওর কথা বলা আছে, সেই ভিডিওটি আসামির মোবাইল থেকে করা হলেও তিনি তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেননি এবং পিবিআই থেকে তদন্ত প্রতিবেদনে একই কথা বলা হয়েছে। তাই ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৬ ও ৩১ ধারায় এ মামলা চলে না।
ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আরো বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম জোর করে ভিডিও করেননি। তিনি নিজে কাউকে ভিডিও দেননি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় মামলা করতে গেলে তদন্ত কর্মকর্তার অনেক তথ্য জানতে হয় এবং তদন্তের জন্য তিনি ভিডিও করেছেন।
আইনজীবী বলেন, ওসি মোয়াজ্জেম যখন টয়লেটে যান তখন সাংবাদিক সজল তাঁর মোবাইল থেকে ভিডিওটি নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এজন্য তিনি থানায় ওই দিনই সাধারণ ডায়েরি করেছেন। সাংবাদিক সজলের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত। কিন্তু এখানে ওসি মোয়াজ্জেম আসামি হতে পারেন না। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে ২৯ ধারার কথা বলা আছে, তা জামিনযোগ্য ধারা। এ ধারার অর্থ হলো যে কোনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে কারো মানহানি ঘটানো। কিন্তু এখানে ব্যারিস্টার সুমনের কোনো মানহানি হয়নি। তিনি এ মামলা করতে পারেন না।
এরপর আইনজীবী শুনানি শেষ করে আদালতের কাছে নিবেদন করে বলেন, মাননীয় আদালত আমরা আইনজীবীরা ন্যায়বিচার করার জন্য যেকোনো পক্ষে মামলা পরিচালনা করি। ব্যারিস্টার সুমন একজন ভাইরাল ব্যক্তি। তিনি ফেসবুকে যা বলেন তা ভাইরাল হয়ে যায়। গত ধার্য তারিখে তিনি ফেসবুকে বলেছেন, ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে বড় বড় সিনিয়র আইনজীবী মামলা পরিচালনা করছেন, তাতে আমি বিস্মিত। বিজ্ঞ আদালত, আমি আপনার মাধ্যমে ব্যারিস্টার সুমনকে বলতে চাই, মামলা পরিচালনার বিষয়ে তিনি যেন ফেসবুকে কোনো বক্তব্য না দেন।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম শুনানিতে বলেন, বিজ্ঞ আদালত এ মামলায় একটা প্রমাণই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার জন্য যথেষ্ট। প্রথম কথা হলো তিনি ভিডিওটি করেছেন কি না? আসামিপক্ষের আইনজীবীও বলছেন না তিনি ভিডিও করেননি। ওসি ভিডিও করার সময় নুসরাতকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তুমি যা বলেছ তা রেকর্ড হচ্ছে। একজন সাংবাদিক তাঁর মোবাইল থেকে ভিডিও নিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন, যা আসামিপক্ষ দাবি করছেন। কিন্তু কথা হলো, মোবাইল একটা সিকিউর জিনিস। আর সেটার সংরক্ষণের দায়িত্ব আসামির নিজের। তিনি তা আনসিকিউর রেখে চলে গেলেন।
ব্যারিস্টার সুমনের মামলা করার বিষয়ে পিপি বলেন, মানবতার কারণেই তিনি মামলা করেছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা সব পরিবারের থাকে না। মামলা করার আগে তিনি আবেদন করেছেন। তার যদি মামলা করার অধিকার না থাকত তাহলে আদালত তখনই মামলাটি খারিজ করে দিতে পারতেন। কাজেই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, কারো মান-সম্মান নিয়ে খেলা করা গর্হিত কাজ। ওসি মোয়াজ্জেমের এমন কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। যেখানে ধর্ষিতার নাম প্রকাশ করা যায় না, সেখানে তিনি তার নাম, কোথায় কোথায় হাত দিয়েছে তাও প্রচার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করছি।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে বিচারক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন। এরপর পিপি ওসি মোয়াজ্জেমকে দোষী কিংবা নির্দোষ প্রশ্ন করলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।
এর আগে গত ৯ জুলাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। জামিন আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ওই দিন বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এর আগে ২ জুলাই হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। তার আগে ১৭ জুন তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর আগের দিন ১৬ জুন শাহবাগ এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে কারাগারে ডিভিশন পাওয়ার বিষয়ে আবেদন করা হলে বিচারক ২৪ জুন ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রথম শ্রেণির বন্দির (ডিভিশন) সব সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
সোনাগাজী থানায় মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ‘অসম্মানজনক’ কথা বলায় এবং তাঁর জবানবন্দির ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গত ১৫ এপ্রিল সাইবার ট্রাইব্যুনালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। সেইসঙ্গে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন—পিবিআইর ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ৩০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ২৭ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। একই দিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে একই ট্রাইব্যুনালের বিচারক সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে ১৭ জুন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করেন।
পিবিআইর প্রতিবেদনে বাদীসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনাগাজী থানার চারজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই বলেছে, নুসরাত জাহান রাফির বয়স কম এবং তিনি একজন মাদ্রাসাছাত্রী। তাঁকে কয়েকজন পুরুষের সামনে শ্লীলতাহানির বক্তব্য শোনা এবং তা ভিডিওধারণ করা ন্যায়সংগত নয়। নারী ও শিশুরা যেহেতু শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসেন, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সদস্যদের অনেক বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন।
‘ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় অপরাধ করেছেন।’
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ভুক্তভোগী নুসরাতের মা। পরে সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর সোনাগাজী থানার ওসির কক্ষে ফের হয়রানির শিকার হতে হয় নুসরাতকে। নিয়ম না মেনে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় দুজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তাঁর আইনজীবী ছিলেন না।
গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আগ মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলে নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয় দুর্বৃত্তরা। মামলা তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানালে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
ওই দিন নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে গত ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়।