‘নিবরাসের রুমে আমি ও আব্বু খাবার দিয়ে আসতাম’
তাহরিম কাদেরী তাঁর বাবা, মা ও ভাইকে নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকতেন। সেখানেই নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলাকারী নিহত জঙ্গিদের। আদালতে তাহরিম কাদেরী বলেন, ‘নিবরাসকে রুমে আমি ও আব্বু খাবার দিয়ে আসতাম।’
গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনায় আজ মঙ্গলবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমানের আদালতে সাক্ষ্য দেন তাহরিম কাদেরী।
তাহরিম কাদেরী হচ্ছেন আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত তানভীর কাদেরীর ছেলে। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত হন তানভীর কাদেরী। ওই অভিযানেই পুলিশের হাতে আটক হয় তাহরিম কাদেরী। তাহরিমের যমজ ভাই আদরও নিহত হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত হয় আদর। তাহরিম এখন জামিনে আছেন।
তাহরিম কাদেরী সাক্ষ্যে বলেন, ‘আমি উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করেছি। বর্তমানে ওয়াইড ভিশন স্কুলে লেখাপড়া করছি। আমার সাংগঠনিক নাম রাসেল ওরফে অনিক ওরফে মুয়াজ ওরফে ইসমাই্ল। আমার আব্বুর সাংগঠনিক নাম ছিল জামসেদ ওরফে তোরাব। আর আমার মায়ের নাম ছিল খাদিজা। তবে আমার মায়ের আসল নাম আবেদাতুল ফাতেমা আশা।’
তাহরিম বলেন, ‘উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আমি, আমার যমজ ভাই আদর একত্রে ফজরের নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজে মুসা আর জাহিদ আংকেলের সাথে আমার আব্বুর পরিচয় হয়। সেখানে ফজরের নামাজের পরে মুসা ও জাহিদ আংকেলের সাথে আমার আব্বু আমাদের রেখে জগিং করতে যান। মুসা আর জাহিদ আংকেল পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় প্রায়ই বেড়াতে আসতেন। আমরাও জাহিদ আংকেলের বাসায় যেতাম। কিন্তু মুসার বাসায় যাইনি। জাহিদ আংকেল উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে থাকতেন। জাহিদ আংকেল আগে সেনাবাহিনীর মেজর হিসেবে চাকরি করতেন। একদিন আব্বু আম্মুকে হিজরতের কথা বলেন। প্রথমে আম্মু রাজি ছিলেন না। কিন্তু পরে একদিন আম্মু রাজি হন। পরে আব্বু বলেন, আমাদের এক জায়গায় যেতে হতে পারে। যেখানে খেলার মাঠ নাই, বাসা বাড়ি নাও থাকতে পারে। আবার খাওয়া-দাওয়ার কষ্টও হতে পারে। তারপরে আব্বু হিজরতে যাব কি না, জিজ্ঞেস করলে আমি ও আমার ভাই রাজি হই।
একদিন জাহিদ আংকেল র্যাশ নামের এক লোককে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। তার আসল নাম আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ। তিনি আসার পরই আব্বু আমাকে বায়াত হতে বলেন। তখন আব্বু আমাদের সবাইকে শপথ পড়ান যে, আমরা এই খলিফার বায়াত নিলাম এবং তার আনুগত্য করব ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত কুফরি না দেখা যায়। তার পরে আমরা আস্তে আস্তে লাগেজ গোছাতে থাকি। এরপর গাইবান্ধায় আমাদের দাদা-দাদুকে ফোন করে বলি, মালয়েশিয়ায় বেড়াতে যাচ্ছি, ওখানে আমরা সেটেল্ড হয়ে এরপর যোগাযোগ করব। এরপর আমরা মিরপুরের আরিফাবাদে চলে আসি। সেখানে আমার আব্বু একটি বাসা ভাড়া নেন। মুসা ও জাহিদ আংকেল আমাদের আগে হিজরত করেন। তবে তারা কোথায় গেছেন, আমরা জানতাম না। কেউ কারো ঠিকানা জানতাম না। তবে মুসা আংকেল আমাদের দুই ভাইকে পল্লবীর বাসায় থাকার সময় অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞান পড়াতেন। আমাদের পল্লবীর বাসায় র্যাশ ও মুসা আংকেল আসতেন। একদিন আমাদের বাসায় র্যাশ চকলেট ও আকিফুজ্জামান নামের দুজন লোককে নিয়ে আসেন। তারা আমাদের বাসায় ঈমান ও ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতেন। দাবিক নামের ইসলামিক একটি ম্যাগাজিনের সফট কপি চকলেট ও র্যাশ আমাদের বাসায় পেনড্রাইভের মাধ্যমে নিয়ে যেতেন। আমরা তা বাসায় কম্পিউটারে বা এলইডি টিভিতে দেখতাম। একদিন র্যাশ আমাদের বসুন্ধরায় একটি বাসাভাড়া নিতে বলেন। র্যাশ ও চকলেট আমাদের বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া নিয়ে দেন।’
তাহরিম বলেন, ‘২০১৬ সালের রোজার প্রথম দিকে আমরা বসুন্ধরায় আসি। সেখানে ছয়-সাত দিন থাকার পরে চকলেট আমাদের বাসায় আসেন। চকলেট আসার দুই তিন দিন পরে প্রথমে তিনজন ও পরে দুজনকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। তাদের সাংগঠনিক নাম সাদ, মামুন, উমর, আরিফ ও শুভ। তারপর আমাদের বাসায় আসেন তামিম, মারজান ও রাজীব গান্ধী। এর মধ্যে রাজীব গান্ধী তার স্ত্রী ও ছেলে শুভকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসেন। আমরা তামিমকে ব্যাটম্যান বলে ডাকতাম। তিনি রুমেই খাওয়া-দাওয়া ও নামাজ পড়তেন। তারা ঘর থেকে তেমন একটা বের হতেন না। রাজীব গান্ধী ও তার ছেলে একরুমে থাকতেন। আমার আম্মু ও রাজীব গান্ধীর স্ত্রী এক রুমে থাকতেন। আমার আব্বু, আমি ও ভাই ড্রইং রুমে থাকতাম। আমি ও আমার ভাই স্কুলে যেতাম না।
গুলশান হামলার পরে জেনেছি সাদের পুরো নাম নিবরাস, মামুনের প্রকৃত নাম রোহান এবং উমরের প্রকৃত নাম ছিল খায়রুল ইসলাম পায়েল বাঁধন। শুভ ভাইয়ার নাম ছিল মোবাশ্বর। আরিফ ভাইয়ের প্রকৃত নাম ভুলে গেছি। একদিন মারজান ও চকলেট আমাদের বাসায় পাঁচটি ব্যাগ কাঁধে ও হাতে করে নিয়ে আসে। ব্যাগের ভেতরে অস্ত্র, চাপাতি ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম ছিল। নিবরাস, মামুন ও শুভ ভাইয়ারা হলি আর্টিজান চিনতেন। তাদের নিয়ে প্রথমে মারজান ও চকলেট রেকি করতে যান। চকলেটের প্রকৃত নাম মনে হয় বাশারুজ্জামান। তারা রেকি করে আসার পরে আরেকদিন সাদ, মামুন, শুভ, আরিফ, তামিম, মারজান, চকলেট ও উমর রেকি করে আসেন। রেকি করে তারা রাত ১১টায় আসেন।’
সাক্ষ্যে তাহরিম আরো বলেন, ‘আমি তারিখ মনে করতে পারছি না, তবে সব ঘটনা ঘটেছে রোজার মধ্যে। তামিমসহ অন্যরা ওই রুমে প্রশিক্ষণ নিতেন। রাজীব গান্ধীকে আমরা জাহাঙ্গীর নামে চিনতাম। রাজীব গান্ধী আমাদের গল্পের মধ্যে বলেন, তিনি নাকি ডাকাতি করে এক লোকের টাকা ছিনতাই করেছেন। আরিফ ও উমর বলেন, তারা নাকি আগেও অপারেশন চালিয়েছেন। কোন জায়গায় নাকি এক বৌদ্ধ ও হিন্দু লোককে তারা কুপিয়েছেন এবং প্যান্টে রক্ত লেগে যাওয়ায় তারা নাকি প্যান্ট খুলে দৌড় দিয়েছেন।
একদিন টাক করে সরোয়ার আংকেল নামের এক লোক আসেন। চকলেট আংকেল তাকে নিয়ে আসেন। তিনিসহ নিবরাসদের রুমের সবাই হামলার বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে কোথায় হবে আমরা তা জানতাম না। সাদ শুধু বলতেন, বড় একটি ঘটনা ঘটবে। সরোয়ার তাদের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনা করেন। তামিম একদিন চকলেটকে বলেন যে নিবরাস, মামুন ওরফে রোহান, আরিফ, শুভ ও উমরের জন্য পাঁচটি নতুন জামা-প্যান্ট আনতে। নিবরাসকে রুমে আমি ও আব্বু খাবার দিয়ে আসতাম। একদিন খাবার দিতে গিয়ে দেখি যে, উমর সিরিষ কাগজ দিয়ে চাপাতি ধার দিচ্ছেন। তারপরের দিন বা দুই দিন পরে রাজীব গান্ধীরা দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে বাসা থেকে চলে যান। পরে নিবরাস, মামুন ও শুভ বাসা থেকে বিকেল আনুমানিক ৫টায় বের হন। তার পরে উমর ও আসিফ বাসা থেকে বের হন। তারা বের হওয়ার সময় অস্ত্র কাঁধে নিয়ে বের হন। তারা যাওয়ার সময়ে আমাদের থেকে বিদায় নেন এবং বলেন জান্নাতে গিয়ে দেখা হবে ইনশা আল্লাহ। তারপরে তামিম ও মারজান তাদের কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বের হন। চকলেট বের হওয়ার সময় আব্বুকে বলেন, আমরা যেন সন্ধ্যা হওয়ার আগে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। আধা ঘণ্টা পরে আব্বু ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে এলে আমরা সন্ধ্যা ৭টার দিকে পল্লবীর বাসায় চলে আসি। আমরা জানতাম যে, কোথাও না কোথাও ঘটনা ঘটবে। আব্বু খবরে দেখেন যে, গুলশানের হলি আর্টিজানে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। তখন আব্বু বলেন, দোয়া করো যেনো ভালো একটা অপারেশন হয়। তখন আমরা আবার অনলাইনে দেখি হামলাকারীরা নিহত।’
তাহরিম বলেন, ‘তখন র্যাশ আমাদের বাসায় আসেন এবং রূপনগরে বাসা নিতে বলেন। আমরা রূপনগরে চলে যাই। সেখানে এক মাস থাকার পরে র্যাশ আজিমপুরে বাসা নিতে বলেন। আমরা দুই বাসাতেই থাকতাম। আজিমপুরের বাসায় আফরিন ও প্রিয়তি আন্টিরা আসেন। একজন মারজানের স্ত্রী, আরেকজন চকলেটের স্ত্রী। রূপনগর থাকাকালীন আমার ভাইকে আব্বু আরেক জায়গায় পাঠিয়ে দেন। আমার ভাইকে আমি আর দেখি নাই। পরে শুনি, আমার ভাই আশকোনায় অভিযানে মারা গেছেন। তাও জেনেছি আমি গ্রেপ্তারের পরে। সেখানে আব্বুসহ আমরা ধরা খাই। আব্বু অভিযানে মারা যান।’
এরপর আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ তাহরিমকে জেরা করেন।
ফারুক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এ ছাড়া আজ এ মামলায় ফায়রুস মালিহা ও আলম চৌধুরী সাক্ষ্য দেন। তবে আলম চৌধুরী নামের আরেক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। বিচারক আগামী ২৩ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।
এদিকে আজ এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ উপলক্ষে কারাগারে থাকা ছয় জঙ্গিকে হাজির করে পুলিশ। তাঁরা হলেন—জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান ও হাদিসুর রহমান সাগর।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর আলোচিত মামলাটির বিচার শুরুর নির্দেশ দেন একই আদালত।
গত বছরের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর গুলশান হামলা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়। পরে অবশ্য হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস।
এ মামলায় অভিযোগপত্রে ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন আসামি বিভিন্ন অভিযানে ও পাঁচজন হলি আর্টিজানে অভিযানের সময় নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া জীবিত আটজনের মধ্যে ছয়জন কারাগারে এবং বাকি দুজন পলাতক। পলাতক দুই আসামি হলেন শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গি হলেন রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
এ ছাড়া বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানে নিহত আটজন হলেন—তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় বন্দুকধারীরা। হামলার পর রাতেই তারা ২০ জনকে হত্যা করে। সেদিনই উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়।
জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করে। সংগঠনটির মুখপত্র ‘আমাক’ হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে বলে জানায় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’।
এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলার পর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকে দুই দফা রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে, এ মামলায় কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে আটক রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি এ মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।