জাহালমের ঘটনায় দোষ স্বীকার করে প্রতিবেদন পড়ে শোনাচ্ছে দুদক
মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিনা দোষে জাহালমকে প্রায় তিন বছর জেল খাটানোর ঘটনায় নিজেদের দোষ স্বীকার করে ২৪ পৃষ্ঠা প্রতিবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপন (পড়া) শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আজ মঙ্গলবার দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান প্রতিবেদন উপস্থাপন (পড়েন) করেন। জাহালমের পক্ষে আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত এবং ব্যাংকের পক্ষে আসাদুজ্জামান উপস্থিত রয়েছেন।
এর আগে গত ১১ জুলাই আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়ে এ বিষয়ে শুনানির জন্য সময় চায় দুদক। পরে আদালত আজ ১৬ জুলাই শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন আদালত।
দায় স্বীকার করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদকের সহকারী পরিচালক সেলিনা আখতার মনির চাপে পড়ে তদন্ত কর্মকর্তা ফয়সাল কায়েস যে ব্যক্তিকে আবু সালেক হিসেবে হাজির করেন, তাঁকেই সব তদন্ত কর্মকর্তা আবু সালেক হিসেবে মেনে নেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তাদের তদারককারীরা এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাহালমের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদানের পর ইনহাউস প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা যোগদান করেন। এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে এটা ছিল তাঁদের জীবনের প্রথম তদন্ত। ফলে তাঁদের পক্ষে মামলার তদন্ত কার্যক্রম নিবিড়ভাবে তদারক করা সম্ভব ছিল না। তদুপরি কমিশনের অনুসন্ধান/তদন্ত কার্যক্রমের সঠিক ও নিবিড় তদারকি ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় তদারক কাজ দায়সারাভাবেই চলে আসছে। ফলে নবীন কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব এবং কাজের যথাযথ তদারকি ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে এ ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংঘঠিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই তদন্তে আত্মসাৎ হয়েছে ১৮ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা এই টাকা কোথায় গেল, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেননি।
এ ছাড়া এ মামলায় অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা জড়িত থাকলেও এবং তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকলেও তাদের কাউকে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযুক্ত করা হয়নি। কিন্তু তাদের অভিযোগপত্রভুক্ত করা উচিত ছিল।
মামলার এজাহারে জাহালম নামে কাউকে আসামি করা হয়নি। তবে প্রকৃত আসামি মো. আবু সালেকের দেওয়া ভুয়া ঠিকানা যাচাই-বাছাই করেননি অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। এতে করেই জাহালম ফেঁসে যায়। কারণ, প্রকৃত আসামি মো. আবু সালেক নিজের ঠিকানা না দিয়ে জাহালমের বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেছিল।
দুদক তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভুলে জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে শনাক্ত করার ঘটনাটি ঘটে উল্লেখ করে প্রতিবেদেন বলা হয়েছে, ‘সার্বিক বিবেচনায় আমার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, জাহালমকে আবু সালেক রূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে, তা দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। আর তাদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং অ্যাকাউন্টের ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয়দানকারীরা। তবে সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদঘাটন করে আদালতের নিকট তা উপস্থাপন করাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর বা অন্য কারো ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এটা লক্ষ্য করা উচিত ছিল যে, প্রথমে কিন্তু ব্যাংক কর্মকর্তারা কিংবা অ্যাকাউন্টের শনাক্তকারীরা আবু সালেককে শনাক্ত করতে কিংবা তাঁকে খুঁজে বের করতে তৎপর হয়নি। যখন তিনটি মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয় এবং সেখানে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আসামি করা হয় তখন বুঝতে পারে যে, মূল আসামি আবু সালেককে খুঁজে বের করে দিতে না পারলে তারা নিশ্চিতভাবেই বাকি মামলাগুলোতে আসামি হয়ে যাবে। তখন তারা যেভাবেই হোক, আবু সালেককে খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যে কাজটি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের করা উচিত ছিল সে কাজটি করতে মাঠে নেমে পড়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা। তারা যেনতেন প্রকারে একজন আবু সালেককে দুদকের সামনে হাজির করে ও তাঁকে আবু সালেকরূপে শনাক্ত করে। ব্যাংক কর্মকর্তারা যে নিজেদের বাঁচাতে যেকোনো ব্যক্তিকে আবু সালেক হিসেবে শনাক্ত করতে পারে, এই সম্ভাবনাটাই তদন্তকারী কর্মকর্তারা ভেবে দেখেননি। তদারককারীও আইওদের এ বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ৩৩টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে মামলার তদন্ত করেননি। প্রত্যেকেই একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রত্যেকেই আশায় ছিল, অন্যরা তদন্তে কোনো অগ্রগতি করলে তারা সেটি কপি করবে এবং সেটিই তারা করেছে। এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম ছিল সেলিনা আখতার মনি। শুধু সে-ই আবু সালেককে শনাক্ত করা বা খুঁজে বের করার জন্য তৎপর ছিল।’
আর দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভুল পথে চালিত করতে ভূমিকা রেখেছেন ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা এবং অ্যাকাউন্টের (ব্যাংক হিসাব) ভুয়া ব্যক্তিকে পরিচয় দানকারীরা।
প্রতিবেদন দাখিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বলেন, সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদ্ঘাটন করে আদালতের কাছে উপস্থাপন করা তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তা বা অন্য কারো ওপর এই দায়িত্ব অর্পণের কোনো সুযোগ নেই।
এর আগে জাহালমকে কেন ক্ষতি পূরণ দেওয়া হবে না, এ মর্মে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।
একটি জাতীয় দৈনিকে ‘৩৩ মামলায় ভুল আসামি জেলে’ ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।
ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত। প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপনের পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট। এ বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান।
মূলত দুদকের একটি চিঠির মাধ্যমে ঘটনার শুরু। জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। জাহালম তখন নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
দুদকের ওই চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যার সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় জাহালমের জীবনে। নির্ধারিত দিনে দুই ভাই হাজির হন দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। তখন জাহালম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’
দুদকে হাজিরা দেওয়ার পর জাহালম চলে যান নরসিংদীর জুট মিলে তাঁর কর্মস্থলে। এর দুই বছর পর টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জাহালমের খোঁজ করতে থাকে পুলিশ। সেখান না পেয়ে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে জাহালমকে আটক করা হয়।
আর তখন জাহালম জানতে পারেন, তাঁর নামে দুদক ৩৩টি মামলা করেছে। ২৬টিতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, তিনি অনেক বড় অপরাধী। পুলিশের কাছেও জাহালম একই কথা বলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ তখন কেউ শোনেনি তাঁর আকুতি। তাঁকে পাঠানো হয় কারাগারে।
এরই মধ্যে কারাগারে কেটে যায় আরো দুটি বছর। জাহালমকে যতবার আদালতে হাজির করা হয়, ততবারই তিনি বলেন, ‘আমি জাহালম। আমার বাবার নাম ইউসুফ আলী। মা মনোয়ারা বেগম। বাড়ি ধুবড়িয়া গ্রাম, সাকিন নাগরপুর ইউনিয়ন, জেলা টাঙ্গাইল। আমি আবু সালেক না।’
এদিকে তাঁর ভাই শাহানূর দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন। হাজতখানার পুলিশ থেকে শুরু করে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী যাকে পান, তাকেই বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই নির্দোষ।’ অথচ ব্যাংক, দুদক, পুলিশ সবার কাছেই জাহালম হলেন, ‘আবু সালেক’ নামের ধুরন্ধর ও ব্যাংক জালিয়াতিকারী।