দুই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, পেছনে রেখেও খুঁজে পায় না পুলিশ
সোনা চোরাচালান ও অর্থ পাচারের দুটি মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। জয়পুরহাট সদর ও পাঁচবিবি থানা পুলিশের কাছে পলাতক তিনি। তবু তিন বছর ধরে পুলিশের ছত্রছায়ায় পাশের দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় অবাধে ব্যবসা ও অন্যান্য কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
পলাতক আসামির নাম ইদ্রিস আলী মিঠু (৪৩)। তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার সীমান্তপথে সোনা চোরাচালানের মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। বাড়ি পাঁচবিবির বাগজানা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কয়া গ্রামে।
সোনা চোরাচালানের ওই মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাঁচবিবির আটাপাড়া রেলগেট এলাকা থেকে দুই কোটি টাকা মূল্যের দুই কেজি সোনা ও একটি মোটরসাইকেলসহ শামসুল আলম (৪৫) নামের সোনা পাচারকারী চক্রের এক সদস্যকে আটক করে তৎকালীন বিজিবি ৩ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। সে সময় মমতাজ উদ্দীন (৫০) ও শাখাওয়াত হোসেন (৪০) নামে শামসুলের আরো দুই সঙ্গী পালিয়ে যান। শামসুল উপজেলার ধরঞ্জী গ্রামের বাসিন্দা।
ওই দিনই ভারতে সোনা পাচারের অভিযোগ এনে ‘১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-খ (১) (ক) ২৫-ঘ’ ধারায় পাঁচবিবি থানায় মামলা (মামলা নম্বর- ১৯) করেন বিজিবির ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম।
এদিকে আটক শামসুল সে সময় নিজেকে সোনা বহনকারী দাবি করে সোনার প্রকৃত মালিক হিসেবে ঘটনার সময় পালিয়ে যাওয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী ভুঁইডোবা গ্রামের মমতাজ ও চেঁচড়া গ্রামের শাখাওয়াতের নাম উল্লেখ করেন। তাঁদেরও ওই মামলায় আসামি করা হয়।
জয়পুরহাট আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচবিবি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল হান্নান জব্দ করা সোনার মালিক হিসেবে শামসুল আলম, শাখাওয়াত হোসেন, ইদ্রিস আলী মিঠু, সুমন, ওয়াদুদ, আজিজার ও সুজনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন (অভিযোগপত্র নম্বর ২১০)।
তদন্তকালে মমতাজ উদ্দিন, আসিদুল ও সাবু নামের তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান আদালতের কাছে প্রার্থনা জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৭ জুলাই জয়পুরহাটের স্পেশাল ট্রাইবুনালের বিচারক সন্দিগ্ধ অভিযুক্ত আসিদুল ও সাবুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন।
এদিকে মামলাসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহকালে মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি ইদ্রিস আলী মিঠুর বিরুদ্ধে জয়পুরহাট সদর থানায় একটি মানি লন্ডারিং মামলার তথ্যও পাওয়া যায়।
জয়পুরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, চলতি দায়িত্ব) মমিনুল হক জানান, ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাট সদর থানায় (জিআর নম্বর-৫১, ধারা-১৩) ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করা হয়। থানার এসআই মেহেদি হাসান ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। ওই মামলায় ২০০৫ সালের ২৬ জুন ইদ্রিস আলীসহ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (অভিযোগপত্র নম্বর- ১৬৯) দেওয়া হয়েছিল। আদালত ওই মামলাতেও ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু ইদ্রিস আলী পাশের হাকিমপুর উপজেলায় চলে যান।
এদিকে হাকিমপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আসামি ইদ্রিস আলীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
গত ৩ জুন হাকিমপুর থানা কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পক্ষ থেকে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে পেছনে বসা সোনা চোরাচালান মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি ইদ্রিস আলী মিঠু (গোল চিহ্নিত)। সামনে বসা হাকিমপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ও পাঁচবিবি থানার ওসি বজলার রহমান। ছবি : সংগৃহীত
স্থানীয় সাংবাদিকদের সূত্রে জানা যায়, গত ৩ জুন হাকিমপুর থানা কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের পক্ষ থেকে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথিদের অন্যতম ছিলেন সোনা চোরাচালান মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি ইদ্রিস। সংরক্ষিত মঞ্চের পেছনের সারিতে বসে ইদ্রিস ইফতার পার্টিতে অংশ নেন। অনুষ্ঠানে হাকিমপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন ব্যক্তির পাশে তাঁকে বসতে দেখা যায়। শুধু তাই নয় ইফতার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পাঁচবিবি থানার ওসি বজলার রহমানকেও উপস্থিত থাকতে দেখা যায়।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সত্ত্বেও আসামি ইদ্রিসকে কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাঁচবিবি থানার ওসি বজলার রহমান জানান, পাঁচবিবি সীমান্তে সোনা চোরাচালান মামলায় আদালতের নির্দেশে চার্জশিটভুক্ত আসামি ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে ডব্লিউএ (ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট) জারি করা হয়েছে। কিন্তু ইদ্রিস তাঁর নিজের গ্রাম পাঁচবিবির কয়াতে থাকেন না। তিনি বর্তমানে পাশের হাকিমপুর উপজেলার হিলিতে বসবাস করেন। তাই দীর্ঘদিন তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে বর্তমানে হাকিমপুর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে হাকিমপুর থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ইদ্রিসের সঙ্গে তাঁর সামাজিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ইদ্রিস হিলি পোর্টের একজন ব্যবসায়ী, আমদানি-রপ্তানিকারক। তা ছাড়া উপজেলা যুবলীগের সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্ত। তাই সামাজিকভাবে তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাতায়াত আছে। এমন অনেকের সঙ্গেই তো আমাদের পরিচয় হয়।’ তবে ইদ্রিসের নামে যে সোনা চোরাচালান মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, তা তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
সোনা চোরাচালান মামলার বর্তমান অবস্থা জানতে জয়পুরহাটের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও জেলা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এ মামলায় যে ব্যক্তিদের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একমাত্র ইদ্রিস আলী মিঠু ছাড়া অন্য সব আসামি হাইকোর্ট থেকে নেওয়া জামিনে রয়েছেন। ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও জামিন না নিয়ে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তিনি পলাতক রয়েছেন।
এ পর্যন্ত আদালতের বেশ কয়েকটি হাজিরায় অনুপস্থিত থাকায় গত ২২ মার্চ জাতীয় দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ ও ১২ মার্চ আঞ্চলিক দৈনিক ‘মায়ের আঁচল’ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আদালত ইদ্রিসকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু অদ্যবধি তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি। ফলে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব হলো ইদ্রিসকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা’, বলেন পিপি নৃপেন্দ্রনাথ। আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে ইদ্রিসের অনুপস্থিতিতেই যথা নিয়মে বিচারকাজ চলবে বলে জানান তিনি।