মালয়েশিয়ায় শ্রমশক্তি রপ্তানির ‘সিন্ডিকেট’ তদন্তে দুদকও থাকবে
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির ‘সিন্ডিকেট’ এবং তাদের অনিয়ম তদন্ত করতে সরকারের পক্ষ থেকে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সদস্যও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।
হাইকোর্টের আদেশে গঠিত ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে বিষয়গুলো তদন্ত করে আগামী ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ৯ সদস্যের কমিটি থেকে দুদকের প্রতিনিধি প্রত্যাহার চেয়ে করা আবেদন খারিজ করেছেন আদালত।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল।
পরে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশে সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কমিটি গঠন করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ওই কমিটিতে দুদকেরও একজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।’
দুদক কমিটি থেকে তাদের প্রতিনিধির নাম প্রত্যাহার করতে আদালতে আবেদন করেছিল। কিন্তু আদালত তাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি। আদালত দুদকের প্রতিনিধিসহ ৯ সদস্যের কমিটিকে সিন্ডিকেটের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন।
এর আগে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো নিয়ন্ত্রণকারী ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গঠন করা কমিটি আদালতে দাখিল করা হয়।
হাইকোর্টের আদেশে গঠিত কমিটিতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার), বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার), পরিচালক (বাণিজ্য সংগঠন) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়/যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার), বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার), দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার), পুলিশ মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি (ডিআইজি পদমর্যাদার)।
এর আগে এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো ক্ষেত্রে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন আদালত।
একই সঙ্গে শুধু ১০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালেশিয়ায় লোক পাঠানো নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা নিতে সরকারের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ওই ১০ এজেন্সির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।
সিন্ডিকেটের ১০টি এজেন্সি হলো—ক্যারিয়ার ওভারসিজ, এইচএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড, আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম ও আল ইসলাম ওভারসিজ।
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি উপেক্ষা করে ১০ এজেন্সির মাধ্যমে লোক নেওয়ার ঘটনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বঞ্চিত অপর ১০টি এজেন্সি ২০১৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বাজার মালয়েশিয়া ২০০৯ সালে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০১২ সালে সরকারিভাবে কর্মী পাঠাতে দুই দেশ চুক্তি করে। এরপর আড়াই বছরে আট হাজার কর্মী যান। তবে সাগরপথে অবৈধভাবে বিপুলসংখ্যক লোক মালয়েশিয়ায় যান। ২০১৫ সালের মে মাসে থাইল্যান্ডে এবং পরে মালয়েশিয়ায় গণকবর পাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে হৈচৈ হলে আবারও বাংলাদেশ থেকে বেসরকারিভাবে কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় মালয়েশিয়া।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে জি টু জি প্লাস (সরকারি-বেসরকারি) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই মালয়েশিয়া জানায়, এ মুহূর্তে তারা আর কর্মী নেবে না। এতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ঝুলে যায়। এরপর ২০১৬ সালের নভেম্বরে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। ওই বৈঠকে আবার কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের এক বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানো শুরু হয়।
জি টু জি প্লাস চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী, কর্মী নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া হয় অনলাইনে। এ কাজের জন্য সিনারফ্ল্যাক্স নামে একটি কোম্পানিকে নিয়োগ দেয় দেশটির সরকার। মালয়েশিয়ান কোম্পানি সিনারফ্ল্যাক্সের সঙ্গে বর্তমানে কর্মী পাঠানো ১০টি এজেন্সি সিন্ডিকেট করে। তাদের দাবি, সিন্ডিকেটের ফলে একদিকে অন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মী পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগে শ্রমিকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে।