‘উপস্থিত না হলে ব্যবস্থা’ লিখেনি বলে দুদক কর্মকর্তাকে শোকজ
সংবাদ প্রকাশ করায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দুই সাংবাদিককে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চিঠিতে একজনকে দুদক কার্যালয়ে উপস্থিত না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু অন্যজনের চিঠিতে ‘অন্যথায় আইনানুগ কার্যধারা গৃহীত হবে’ লেখা বাক্য ছিল না। এজন্য চিঠি ইস্যুকারী দুদক পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের দলনেতা শেখ মো. ফানাফিল্যাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছে দুদক।
আজ বুধবার দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন) জহির রায়হান ওই নোটিশ দিয়েছেন শেখ মো. ফানাফিল্যাকে।
জহির রায়হান স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়, “আপনি শেখ মো. ফানাফিল্যা (পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন) কমিশনের পরিচালক (সাময়িক বরখাস্ত) খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের নিকট থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অনুসন্ধান টিমের প্রধান করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আপনি অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষ্য শ্রবণ ও গ্রহণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধি মতে বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি দীপু সারোয়ারকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আইনানুগ কার্যধারা গৃহীত হবে মর্মে গত ২৫ জুনে নোটিশ প্রদান করেন। একই অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষ্য শ্রবণ ও গ্রহণ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধি মতে এটিএন নিউজের ইমরান হোসেন সুমনকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো মর্মে গত ২৫ জুনে (হবে ২৪ জুন) নোটিশ প্রদান করেন। ইমরান হোসেন সুমন বরাবর প্রেরিত নোটিশে ‘অন্যথায় আইনানুগ কার্যধারা গৃহীত হবে’ মর্মে উল্লেখ করেননি, যা অনুসন্ধান সংক্রান্ত প্রচলিত নোটিশের ফরম্যাট বহির্ভূত।”
নোটিশে আরো বলা হয়, ‘আপনি উপর্যুক্ত একই বিষয়ে বর্ণিত দুজন ব্যক্তির একজনকে প্রচলিত ফরম্যাট অনুযায়ী এবং অপরজনকে প্রচলিত ফরম্যাট বহির্ভূত ভিন্নতর নোটিশ প্রদান করে আপনার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, যা অসদাচরণের শামিল।’
দুদক মহাপরিচালকের নোটিশে বলা হয়, ‘উল্লেখিত কারণে কেন আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার কারণ অত্র নোটিশ প্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে জানানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
এদিকে দুই সাংবাদিককে চিঠি দেওয়ার প্রতিবাদে আজ বুধবার সকালে রাজধানীর সেগুন বাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। দুদকের চিঠি প্রত্যাহার করাসহ চার দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন সাংবাদিকরা।
বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তৃতাকালে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু জাফর সূর্য দাবিগুলো তুলে ধরে এ ঘোষণা দেন। দাবিগুলো হলো−দুদক যে আপত্তিকর ভাষায় চিঠি দিয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে, দুদকের দেওয়া চিঠি প্রত্যাহার করতে হবে, যিনি চিঠি ইস্যু করেছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে।
আবু জাফর সূর্য বলেন, ‘সত্য প্রকাশে কোনোভাবেই সাংবাদিকদের বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিতে হবে। আমাদের দাবিগুলো ২৪ ঘণ্টার ভেতরে বাস্তবায়ন করতে হবে দুদককে। না হলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় দুদক কার্যালয়ের সামনে ফের সমবেত হবেন সাংবাদিকরা।’
নোটিশ পাওয়া সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দীপু সারোয়ার বলেন, ‘দুদক আইন, তাদের যে বিধিমালা এবং ফৌজদারি কার্যবিধি উল্লেখ করে আমাকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেটি আসলে সমন পর্যায়ে পড়ে। আপনি হাজির হবেন, না হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমার রিপোর্টকে কেন্দ্র করে তারা যদি তথ্যগত সহযোগিতা চায় তাহলে চিঠির ভাষা এমন হতে পারে না। আমার সহকর্মী, অফিস এবং সাংবাদিক বন্ধুরা বিষয়টিকে অত্যন্ত অপমানজনক হিসেবে দেখেছেন। সেজন্যই আমি আজকে দুদকের মুখোমুখি হইনি। আমি যথা উপযুক্ত তথ্য দিয়ে খবর প্রকাশ করেছি। সাংবাদিকতার সব নৈতিকতা মেনে আমি খবরটি প্রকাশ করেছি। দুদক কিন্তু আমার এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। তারা আমাকে কেন ডেকেছে তা আমি জানি না।’
সমাবেশ শেষে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তিনি বলেন, ‘দুদকের পক্ষ থেকে দুজনকে ডাকা হয়েছিল। তাঁদের জন্য যে চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল সেই চিঠির ভাষা দুই জায়গায় দুই রকম। বিষয়টি কমিশনের নজরে এসেছে। কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।’
সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সাংবাদিক উপস্থিত না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাহলে সাংবাদিক কী প্রতিবেদন প্রকাশ করে অন্যায় করেছে-এমন প্রশ্নে প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘দুদক থেকে সাক্ষীদের জন্য সাধারণত যে ফরম্যাটে চিঠি দেওয়া হয় সেই ফরম্যাটেই চিঠি পাঠানো হয়েছে দুজন সাংবাদিককে। ২০১২ সালের একটি কমন ফরম্যাট চলছে। তবে চিঠিতে কিন্তু দুজন সাংবাদিককে কিন্তু দুই রকম লেখা হয়েছে।’
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, কেন দুই সাংবাদিককে দুই রকম ভাষায় চিঠি দেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে কমিশন শেখ মো. ফানাফিল্যাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।
দুই সাংবাদিককে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘চিঠি প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’
গত সোমবার দুদকের পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের দলনেতা শেখ মো. ফানাফিল্যা স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ পাঠানো হয় এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার ইমরান হোসেন সুমনকে। নোটিশটিতে বলা হয়, দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে আপনার সাক্ষ্যগ্রহণ ও শ্রবণ একান্ত প্রয়োজন। উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে আগামী ২৬/০৬/২০১৯ তারিখ ১০.০০ ঘটিকায় নিম্নস্বাক্ষরকারীর কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হলো।
পরের দিন গতকাল মঙ্গলবার শেখ মো. ফানাফিল্যা স্বাক্ষরিত একই চিঠি পাঠানো হয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিনিধি দীপু সারোয়ারকে। তাঁকেও আজ বুধবার দুদক কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদান করতে বলা হয়। তবে তাঁর নামে পাঠানো নোটিশের শেষ বাক্যে বলা হয়, ‘অন্যথায় আইনানুগ কার্যধারা গৃহীত হবে।’
ইমরান হোসেন সুমনকে শুধু কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদান করতে অনুরোধ জানানো হয়। উপস্থিত না হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু দীপু সারোয়ারকে বলা হয়েছে।