ওসির মনে দুই নম্বরি না থাকলে আত্মসমর্পণ করতেন
ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
আজ সোমবার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। দুপুর সোয়া ২টার দিকে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে কড়া পুলিশি পাহাড়ায় আদালতে নিয়ে আসা হয়। এর পরই তাঁর পক্ষে আইনজীবী মাসুমা আক্তার জামিনের আবেদন করেন।
জামিন আবেদনের শুনানির প্রথমে বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা জামিনের আবেদন বাদীকে অথবা বাদীপক্ষের আইনজীবীকে দেখিয়েছেন কি না? যেহেতু এটা নালিশি মামলা তাই বাদীর অথবা বাদীপক্ষের আইনজীবীকে দেখাতে হবে এবং আবেদনে ‘দেখিলাম’ লিখতে হবে।
এর পরই আইনজীবীরা মামলার বাদী ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমনকে জামিনের আবেদনটি দেখান। তখন ব্যারিস্টার সুমন জামিনের আবেদনে ‘দেখিলাম’ মর্মে লিখেন। এর পরই ব্চিারক জামিন শুনানি শুরু করতে বলেন।
ওসি মোয়াজ্জেম আদালতে প্রবেশের পর তাঁর চোখে সানগ্লাস ছিল। আদালতের সাধারণ আইনজীবীরা ও বিচারপ্রার্থীরা তাঁর চোখ থেকে সানগ্লাস খোলার জন্য ও হাতে হাতকড়া পরানোর জন্য হৈ চৈ শুরু করেন। এরপর আদালত পুলিশ ওসি মোয়াজ্জেমের চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলেন এবং হাতকড়া পরান। দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে জামিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
শুনানির শুরুতে ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন আদালতকে বলেন, মাননীয় আদালত আপনি ২০ দিন আগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থানায় পাঠান। একটা দীর্ঘ তদন্ত শেষে আপনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরোয়ানা পাঠানোর ২০ দিন পরে তিনি (ওসি মোয়াজ্জেম) পুলিশ দ্বারা ধৃত হন। আমি ওই মূল মামলায় যাওয়ার আগে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে আরো দুটি অভিযোগ করতে চাই। তা হলো উনি (ওসি মোয়াজ্জেম) পুলিশের লোক হয়েও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি নির্দোষ হলে আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করতেন। সাধারণ একজন পাবলিক ভয় পেয়ে যেভাবে পালিয়ে যান, তিনি তা করেছেন। উনি আইনের লোক হয়েও গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কথা শুনে ২০ দিন ধরে পলাতক ছিলেন।
শুনানিতে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, এটা পুরো পুলিশ বিভাগের জন্য কলঙ্ক। উনার যদি সত্যিকার অর্থে মনে কোনো দুই নম্বরি না থাকত, তাহলে তিনি আত্মসমর্পণ করতেন। ক্রিমিনাল মামলার অর্থ হলো কোনো ব্যক্তিকে সংশোধন করা, আর উনার মামলার বিষয় হলো কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাহিনীকে সংশোধন করা। এবার সব কিছু আমলে নিয়ে বিজ্ঞ বিচারক আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন তা আমরা মাথা পেতে নেব।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম শুনানিতে বলেন, এ মামলার আসামি ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিহত নুসরাতের ভিডিও প্রচার করেছেন। এতে মানহানি হয়েছে এবং সামাজিকভাবে ভিকটিম নুসরাত হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। বাদীপক্ষে আমাদের আবেদন আসামির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করা হোক।
এর পরই ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে তাঁর আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ শুনানিতে বলেন, আসামি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে। আসামি আইনের আশ্রয় গ্রহণ করার জন্য মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনে যাওয়ার পথে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু বলা হচ্ছে, বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একজন আইনের সেবক হয়ে, আসামি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আত্মসমর্পণ করতে এসেছেন। কিন্তু আসামিকে আত্মসমর্পণের সুযোগ না দিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আসামিকে নিয়ে আসছে।
আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, হাইকোর্টে আসামির টেন্ডার নম্বর আছে। আসামি তাঁর আইনজীবী দিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনে এফিডেভিট করে মামলা জমা দিয়েছেন। যা শুনানির জন্য আছে। আসামি যাচ্ছেন, শুনানি হবে, তখনই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সবাই বলে আমি (ওসি মোয়াজ্জেম) পলাতক ছিলাম।
তখন বিচারক আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, সবাই মানে?
আইনজীবী ফারুক বলেন, অনেকে বলে পলাতক ছিলাম। বিজ্ঞ আদালত, আমি পলাতক ছিলাম না। আমি জানতে পেরেছি আমার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত, বর্তমানে এই ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশে একটাই আছে। আমি আত্মসমর্পণ করার জন্য সিকিউরিটি পাই নাই। আমার সিকিউরিটির সমস্যা। আমি যখন বাইরে বের হই তখন আমাকে পাবলিক ধরে, নানা লোকজন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সাংবাদিক মিডিয়ার সামনে ফেইস করতে হয়। এজন্য বিজ্ঞ আদালত আমি আপনার সামনে আসতে পারি নাই, আপনার আদালতে আসতে পারি নাই। তাই আমি আইনের সেবক হয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আত্মসমর্পণ করতে গিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, আমি ভিডিও শেয়ার করেছি। কিন্তু মাননীয় আদালত, আমি এটা স্টেটমেন্ট হিসেবে নিয়েছি। আমি এটা রেকর্ড করেছি, এটা শেয়ার হয়েছে অন্য জায়গা থেকে।
ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, আমি যেটা বলতে চাই, এ ভিডিও রেকর্ডিং কেন করা হয়েছে? অনেক সময় দেখা যায়, বাদী অথবা ভিকটিম এজাহার থানায় এসে ঠিকই দায়ের করে, তখন তারা আপস করে ফেলে অথবা সরে আসার চেষ্টা করে। এখন বাদী রাগের বশে মামলাটি করল কি না- এ বিষয়ে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।
তখন বিচারক বলেন, আপনি কি তাহলে স্বীকার করে নিলেন, ভিডিও আপনি করেছেন?
তখন আইনজীবী বলেন, না। ভিডিও রেকর্ডের কথা আরজিতে বলা আছে। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাকে জামিন দেন, পলাতক হব না।
শুনানি শেষে বিচারক জামিনের আবেদন খারিজের আদেশ দেন। এরপর আবারও কড়া পাহাড়ায় ওসি মোয়াজ্জেমকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
গতকাল রোববার বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগরের শাহবাগ থানা পুলিশ। এরপর ফেনীর সোনাগাজী থানাকে অবহিত করে তারা।
গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ জানাতে সোনাগাজী থানায় যায়। থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন এবং তাঁর ভিডিও ধারণ করেন। ওই মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় ৬ এপ্রিল আরবি পরীক্ষা চলাকালে নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয় অধ্যক্ষের অনুগত ছাত্রছাত্রীরা। নুসরাতকে সেদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। এরপর নুসরাতের জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ওসি। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান নুসরাত।
ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত শেষে ২৬ মে পিবিআই আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। পরের দিন মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। তারপর থেকেই পলাতক ছিলেন মোয়াজ্জেম।
কী আছে তদন্ত প্রতিবেদনে
গত ২৬ মে পিবিআই সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রিমা সুলতানা ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। সে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা আছে, বিবাদী সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর অফিস কক্ষে উপস্থিত ভিকটিমের অপরিচিত কিছু পুরুষের সামনে যৌন নিপীড়নের বক্তব্য শুনেন এবং ভিডিও ধারণ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ওসি ভিকটিমকে বলেন, অধ্যক্ষের কক্ষে তুমি নিজে গিয়েছিলে কি না, তোমাকে কেউ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল? এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের বিব্রতকর প্রশ্ন করেন।
ওসি ভিকটিম নুসরাতের যৌন হয়রানির বর্ণনা শুনার পরও বলেন, এটা কোনো ব্যাপার না। এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে এমন কাঁদতে হবে। ঘটনার একপর্যায়ে ওসি মোয়াজ্জেম ভিকটিমকে জিজ্ঞাসা করেন অধ্যক্ষ তোমার বুকে হাত দিয়েছিল কি না?
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, যেহেতু নারী ও শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় থানায় আসে, সেহেতু নারী ও শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ সদস্যদের আরো বেশি সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। বিবাদী মোয়াজ্জেম হোসেন ওসি হিসেবে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভিকটিম নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করে ধারণ ও প্রচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।