ইউএনওর কর্তৃত্ব বাতিলের দাবি
উপজেলা পরিষদে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কর্তৃত্ব দেওয়ার অফিস স্মারক বাতিল করে জাতীয় বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়েছে। প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৬ ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি আজ বুধবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এসব দাবি জানায়। সেই সঙ্গে এসব দাবি আদায়ে আগামী ২৪ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সকাল ১০টায় সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন কমিটির সদস্য সচিব ও বিসিএস সমন্বয় কমিটির মহাসচিব মো. ফিরোজ খান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রকৃচি কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সচিব ও বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সবুর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান, বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মহাসচিব মো. মোবারক আলীসহ অন্যরা।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তাঁরা নতুন জাতীয় বেতন স্কেলকে স্বাগত জানান। কিন্তু বেতন স্কেল থেকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বাদ দিয়ে বিভিন্ন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ ও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। তাই অবিলম্বে তা পুনর্বহাল করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এর আগে তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল পুনর্বহাল এবং উপজেলা পর্যায়ে ১৭টি সার্ভিসের সেলফ ড্রয়িং কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য বিলে ইউএনওর স্বাক্ষর ও অযাচিত নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। কিন্তু তাতে সাড়া না দিয়ে তড়িঘড়ি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১৪ অক্টোবর উপজেলা পরিষদের ক্ষমতায়নের নামে ইউএনওর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠামূলক একটি অফিস স্মারক জারি করে। ওই অফিস স্মারক জনপ্রশাসনসহ জাতীয় উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে তাঁরা মনে করেন। একই সঙ্গে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাকে শ্লথ করে ২০২১ সালে মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে।
উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি ও অর্থের ছাড় বরাদ্দের ওপর ইউএনওর খবরদারি উন্নয়ন প্রকল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও মনে করে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। সংবাদ সম্মেলন থেকে বলা হয়, উপজেলা পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা পদমর্যাদা ও বেতন স্কেল ইউএনওর চেয়ে বেশি। নিচের পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা তাঁর উচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তার বেতন-ভাতা নিয়ন্ত্রণ করলে তা সরকারের প্রশাসনিক রীতির পরিপন্থী হবে। তা ছাড়া একজন সেলফ ড্রয়িং কর্মকর্তার বেতনভাতার বিল অন্য বিভাগের কর্মকর্তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল রুলসের পরিপন্থী বলেও জানানো হয়। এই অবস্থায় তাঁরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১৪ অক্টোবরের অফিস স্মারক সংশোধন করে ইউএনওসহ উপজেলা পরিষদের ন্যস্ত করা ১৭ দপ্তরের সব কর্মকর্তার জনপ্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বেতন স্কেল ২০০৯ অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা নবম গ্রেডে যোগদানের পর সন্তোষজনক চাকরির শর্তে চার বছর পর সিলেকশন গ্রেড হিসেবে সপ্তম গ্রেডে উন্নীত হন। চাকরির মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হলে তিনি ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পান। ষষ্ঠ গ্রেডে পাঁচ বছর চাকরির পর একজন কর্মকর্তার পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ সার্ভিসে পদোন্নতির পদ কম থাকায় এসব কর্মকর্তা ষষ্ঠ গ্রেডেই অবস্থান করেন। এ স্তরে সিলেকশন গ্রেড থাকায় এসব কর্মকর্তা পদোন্নতি না পেলেও পঞ্চম গ্রেড লাভ করেন। সিলেকশন গ্রেড বন্ধ করে দেওয়ায় এখন তাঁকে বছরের পর বছর ষষ্ঠ গ্রেডেই অবস্থান করতে হবে। তিনি পদোন্নতি না পেলেও পঞ্চম গ্রেডের স্কেলে আট বছর চাকরি পূর্ণ করলে টাইম স্কেল হিসেবে চতুর্থ গ্রেডে বেতন পেতেন। অর্থাৎ পদোন্নতি না পেলেও ষষ্ঠ গ্রেডের একজন কর্মকর্তার চতুর্থ গ্রেডে বেতন পাওয়ার সুবিধা বিদ্যমান ছিল। ফলে একজন কর্মকর্তা পদোন্নতির সুযোগ না পেলেও যথাযথ মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ তে এসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ বেতন স্কেল অনুযায়ী পদোন্নতি না পাওয়া একজন কর্মকর্তাকে ক্ষেত্রবিশেষে পরবর্তী বেতন স্কেলে উন্নীত হতে ১৮ বছর লেগে যাবে। একইভাবে পঞ্চম গ্রেডের একজন কর্মকর্তা পদোন্নতি না পেলে চতুর্থ গ্রেডে বেতন উন্নীত হতে তাঁকে ১১ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেবে এবং কর্মক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন না। পক্ষান্তরের সরকারের বিশেষ পদ হিসেবে চিহ্নিত উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের সুপারনিউমারি পদ দেখিয়ে নির্ধারিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যথা সময়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা সুপার নিউমারি পদে পদোন্নতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বন্ধ করে দেওয়ায় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে পদ অবনমন হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল পুনর্বহাল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানানো হয়।
গত ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপজেলা পরিষদে মোট ১৭ দপ্তরের হস্তান্তর প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রায় দেড় মাস পর গত ১৪ অক্টোবর এ সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ২৪ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৭ জুন ২০১০ তারিখের প্রজ্ঞাপন ও ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই আইনের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত উপজেলা পর্যায়ের কতিপয় দপ্তর ও কাজ (সংযোজনী-১) উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়। উপজেলা পরিষদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষে পরিষদে হস্তান্তরিত দপ্তর ও কাজের সঙ্গে যুক্ত উপজেলা ও ইউনিয়ন বা এর নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই আদেশ জারির তারিখ থেকে উপজেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত হয়েছেন বলে গণ্য হবেন।
এই ন্যস্ত হওয়ার তারিখ থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের বেতন-ভাতা ও এই সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়ের অর্থ নিজ নিজ উপজেলা পরিষদ থেকে গ্রহণ করবেন। এ ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ৩৫ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ সরাসরি উপজেলা পরিষদের অনুকূলে বরাদ্দ করবে এবং এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানাবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এ সংক্রান্ত বাজেট প্রণয়ন, বরাদ্দ সংগ্রহ, অর্থ ছাড়করণ ও হিসাবরক্ষণ নিশ্চিত করবে বলে পরিপত্রে বলা হয়েছে।