ভৈরবে তানিয়ার আত্মহত্যা : প্রেমিকসহ আটজনের নামে মামলা
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বিয়েতে প্রেমিকের অস্বীকৃতি এবং বখাটেদের নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তানিয়া বেগম (২৩) নামের এক কলেজছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় প্রেমিক মিজানুর রহমান বাবুসহ আটজনের নামে একটি মামলা হয়েছে।
রোববার সকালে তানিয়ার বাবা মিলন মীর বাদী হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করেছেন। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় চার-পাঁচজনকে।
মামলার আসামিরা হলেন ভৈরবের শ্রীনগর গ্রামের প্রেমিক মিজানুর রহমান বাবু (২৮), তাঁর মা হেলেনা বেগম (৫০), বোন রূপালী বেগম (৩০), মধ্যেরচর গ্রামের তানিয়ার বাড়ির প্রতিবেশী শাহ আলম (৪০), নূর আলম সরকার (৪৫), ফিরোজ মিয়া (৩৫), চায়না বেগম (৪৫) ও ফরিদা বেগম (৪০)। পুলিশ আজ দুপুরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জিহাদ ও সানোয়ার হোসেন নামের দুই প্রতিবেশীকে আটক করেছে।
ভৈরবে মেয়ের ব্যাগ দেখিয়ে রোববার আহাজারি করেন মা শেফালি বেগম। ছবি : এনটিভি
এদিকে রোববার বিকেলে তানিয়ার মরদেহ কিশোরগঞ্জে ময়নাতদন্তের পর ভৈরব নিয়ে আসা হয়। পুলিশের উপস্থিতিতে মধ্যেরচর ঈদগাহ মাঠে তার জানাজাশেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে তানিয়ার লাশ বাড়িতে পৌঁছালে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তানিয়া গত শনিবার সকালে নিজ ঘরের আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি স্থানীয় জিল্লুর রহমান সরকারি মহিলা অনার্স কলেজের দর্শন বিভাগের স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানে তাঁর স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। এরই মধ্যে পাঁচটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। বাকি চারটি পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তাঁর।
তানিয়ার বাবা মিলন মীর জানান, তিনি চট্টগ্রামে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করেন। আত্মহত্যার খবর শুনে শনিবার রাতে সেখান থেকে বাড়ি এসেছেন। মেয়ে তার উচ্চ শিক্ষিত হয়ে অনেক বড় হবে, সেই স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। তাঁর সেই স্বপ্ন আজ ধূলিস্যাতে পরিণত হয়েছে। তাঁর স্বপ্নের ময়না উড়ে গেছে, তাঁদের ছেঁড়ে। তিনি সরকারের কাছে তাঁর মেয়েকে যারা নির্যাতন করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে, তাদের বিচার চান।
তানিয়াদের বাড়িঘরে এত বড় বড় ইট ছুঁড়ে মারা হয়। ছবি : এনটিভি
তানিয়ার মাকে দেখা যায় পাগলপ্রায় অবস্থায়। কান্না আর আহাজারিতে তাঁর স্বরও বন্ধ হয়ে যায়। তানিয়া যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে একবার ঢুকছেন, আবার বের হচ্ছেন। মেয়ে যে ব্যাগে বই পুরে কলেজে যেতেন, সেই ব্যাগ হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে বলছেন, ‘আম্মা, আমি যাই।’ আবার নিজেই উত্তরে বলছেন, ‘আচ্ছা মাইও, সাবধানে যাইও।’ এমন করছেন। কখনো নিথর চুপ, কখনো বা প্রলাপ বকছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তানিয়া পড়াশোনার পাশাপাশি পৌর শহরের স্টেডিয়ামপাড়া এলাকার সাজেদা আলাল হাসপাতালে চাকরি করতেন। সেখানকার ফার্মেসিতে চাকরি করতেন উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামের আবুল কালামের ছেলে মিজানুর রহমান বাবু। একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাধে তানিয়া-মিজানের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রেমিক মিজানুর রহমান প্রেমিকা তানিয়ার সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যান। বিষয়টি প্রতিবেশীদের নজরে পড়লে তারা মিজানকে আটক করেন। পরের দিন শুক্রবার সকালে মিজানের অভিভাবকদের নিয়ে সালিশে বসেন প্রতিবেশীরা। এ সময় তানিয়ার অভিভাবকরা তানিয়াকে বিয়ে করতে চাপ সৃষ্টি করলে তাতে অস্বীকৃতি জানান মিজান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। একপর্যায়ে মিজানের বোনেরাসহ আত্মীয়রা তানিয়ার পরিবারকে গাল-মন্দ করে মিজানকে ফেলেই চলে যান। বিপাকে পড়া সালিশকারীরা একপর্যায়ে পরিচিত এক উকিলের পরামর্শে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে মিজানকে ছেঁড়ে দেন।
তানিয়া ও তাঁর মাকে গালিগালাজ করা এবং ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারায় অভিযুক্ত মিজান মীর, আওয়াল মীর, শের আলী মীর ও আলকাস মীর। ছবি : এনটিভি
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেদিন সালিশে উপস্থিত মধ্যেরচর গ্রামের মো. মিনু মিয়া জানান, মিজান তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। শ্রীনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান উসমান গণিসহ তাঁরা কয়েকজন তানিয়া-মিজানের বিয়ের বিষয়ে একমত হয়ে আলোচনায় বসছিলেন। কিন্তু মিজানসহ তাঁর বোনরা সেই বিয়েতে রাজি না হওয়ায় সেটি সম্পন্ন হয়নি। একপর্যায়ে মিজানের আত্মীয়রা মিজানকে ফেলেই চলে যান। এ সময় চতুর মিজান আত্মহত্যার হুমকি দেন এবং বলেন তার কিছু হলে সালিশকারীরা দায়ী থাকবেন। সেই কথায় তাঁরা ভড়কে যান এবং স্থানীয় এক উকিলের পরামর্শে সাদাস্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রেখে তাকে ছেঁড়ে দেন।
মিনুর কথার সত্যতা নিশ্চিত করে উসমান গনি জানান, তিনিসহ অন্যরা মিজানের বোনদের বিয়েতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি চলে আসেন। পরে জানতে পারেন মিজানকে ছেঁড়ে দেন মধ্যেরচরের লোকজন এবং শনিবার সকালে তানিয়া আত্মহত্যা করেছেন।
তানিয়ার চাচা খলিল মীর জানান, মিজানকে ছেঁড়ে দেওয়ার পর এলাকার কিছু বখাটে যুবক এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শুক্রবার দিনে এবং রাতভর তানিয়াসহ পরিবারের লোকজনকে নানাভাবে অপমান করে। অশ্লীল গালাগাল করে। ঘরে ইটপাটকেল ছুঁড়ে এবং রামদা দিয়ে ঘরের টিনের বেড়ায় কুপায়। এতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি।
শনিবার সকালে বাড়িতে এসে নানা রকমের কটু কথা-বার্তা বলতে থাকে। তানিয়াকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। একপর্যায়ে তানিয়া ও ওর মা শেফালি বেগমকে ঘর থেকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে। এসব অপমান সহ্য করতে না পেরে ওই দিন বেলা ১১টার দিকে তানিয়া নিজঘরে আত্মহত্যা করেন।
ভৈরবে প্রেমিক মিজানুর রহমান বাবু ও তার পরিবারের সদস্যরা ঘরে তালা মেরে পালিয়ে গেছে। ছবি : এনটিভি
খলিল মীর ভণ্ডপ্রেমিক মিজানুর রহমান বাবুসহ তানিয়ার ওপর নিপীড়ন করা ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন।
এদিকে গালিগালাজ করা এবং ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারায় অভিযুক্ত মিজান মীর (২৯), লিমা বেগম, আওয়াল মীর (৪৫), শের আলী মীর (৪০), আলকাস মীর (৩০) ও নাদিম মীরের কাছে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো তানিয়া ও তাঁর মা শেফালি বেগম সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে।
অন্যদিকে দুপুরে শ্রীনগর গ্রামে তানিয়ার প্রেমিক মিজানুর রহমান বাবুদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাড়িঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। তাদের প্রতিবেশীদের কাছে জানতে চাইলে কেউ তাদের হদিস জানেন না বলে জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি জানান, শনিবার তানিয়ার আত্মহত্যার খবর জানার পর থেকেই বাড়ির লোকজন গা-ঢাকা দিয়েছে।
ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোখলেছুর রহমান জানান, ঘটনাটি মর্মান্তিক ও দুঃখজনক। প্রেমিকের বিয়েতে অসম্মতি ও প্রতিবেশীদের মানসিক নির্যাতনে তানিয়া আত্মহত্যা করেছে। প্রাথমিক তদন্তে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি। এই ঘটনায় তার বাবা থানায় আটজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছেন। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালাচ্ছে। শিগগিরই আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনগতভাবে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।