শোভাযাত্রায় মঙ্গলবারতা, মাথা তুলে দাঁড়াবার অঙ্গীকার
নানা আয়োজনে সারা দেশে চলছে বর্ষবরণ। পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিতেই এই আয়োজন চলছে শহরে-বন্দরে। জীর্ণতাকে মুছে ফেলে মঙ্গল-কল্যাণকর নতুন বছরের বার্তা ধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে।
বাঙালির নাগরিক জীবনের পয়লা বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ রাজধানীর রমনার বটমূলের ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনাচারের বিরুদ্ধে শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানিয়ে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী এই অনুষ্ঠান। তাদের অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ’।
এরপরই সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। মোট আটটি শিল্পকর্ম দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবারের প্রতিপাদ্য।
ঐতিহ্য মেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আক্তারুজ্জামান এবারের শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। এতে শামিল হন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ। ঢাকা-ঢোল বাজিয়ে নানা মুখোশ হাতে নিয়ে নেচে-গেয়ে এই শোভাযাত্রায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। নানা প্রতীক, চিত্র আর মুখোশের মাধ্যমে সেখানে অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা করা হয়; প্রার্থনা করা হয় সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের জন্য।
ঠিক সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে এই শোভাযাত্রা শুরু হয়। শাহবাগের মোড় হয়ে শিশুপার্ক হয়ে আবার শাহবাগ মোড়ের দিকে আসে। শাহবাগ থেকে শোভাযাত্রাটি চারুকলার হয়ে টিএসসির মোড় হয়ে চারুকলায় গিয়ে শেষ হয়।
ছায়ানট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে ভোর থেকেই রমনার বটমূলে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ। সবার পরনে ছিল নতুন রঙিন পোশাক।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের দায়িত্বে রয়েছে চারুকলা অনুষদের ২১তম ব্যাচ। ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ‘টানা মাসব্যাপী আমাদের প্রস্তুতি চালিয়েছেন তাঁরা। পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপনে পূর্ণতা আনবে প্রতিকৃতিগুলো। মঙ্গলের এ যাত্রাকে সফল করতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চারুকলার সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন শত শত মানুষ। চারুকলা থেকে সারি বেঁধে শুরু হয় এই শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার দুই পাশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাতে হাত দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করেন। বেষ্টনীর ভেতর দিয়ে নাচ-গান করতে করতে আর বাদ্য বাজাতে বাজাতে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন মঙ্গলকামী মানুষ।
খাদিজা আক্তার নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি জাতির উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রতিবছর শোভাযাত্রায় অংশ নিই। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই অনুষ্ঠান এক ভিন্ন আমেজ তৈরি করেছে। শোভাযাত্রা দিয়ে পয়লা বৈশাখ শুরু করে ভালোই লাগছে।’
মূলত এই আয়োজনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় রাজধানীর বৈশাখ বরণের কার্যক্রম। আর তাই এ উৎসবকে সফল করতে গত এক মাস নিরলস পরিশ্রম করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী। শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে পাখি, বাঘ, বক, ঘোড়া, উল্টা কলসি, পেঁচা, কাঠঠোকরাসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতির শিল্পকর্ম।
কেন শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন এমন প্রশ্নে শাহজাদা হক নামের একজন বলেন, ‘অশুভ শক্তির বিনাশ কামনায় এখানে অংশ নিয়েছি। বাঙালি বরাবরই শান্তিপ্রিয় জাতি। শান্তি নেমে আসুক সমগ্র পৃথিবীতে।’
এদিকে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রমনা জোনের ডিসি মারুফ আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘শোভাযাত্রাকে ঘিরে র্যাব ও পুলিশের কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। রয়েছে র্যাবের ডগ স্কোয়াড ও পুলিশের বিশেষ বম্ব ডিসপোজাল টিম। এ ছাড়া রয়েছে পুলিশ কন্ট্রোল রুম। শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের থ্রেট নেই আমাদের। তবে সবকিছুর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত।’
জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করেছে বাঙালি জাতি। পয়লা বৈশাখে বর্ণিল উৎসবে মেতেছে দেশ। চৈত্রসংক্রান্তির মাধ্যমে ১৪২৫ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বছর ১৪২৬।
১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।