আত্মসমর্পণ করার পর আর্ট বাবুর আত্মোপলব্ধি
১৯৯৫-৯৬ সালের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর রমরমা অবস্থা। সেই সময় ছাত্র ফেডারেশনের নেতা আব্দুর রাজ্জাক ওরফে বাবু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র। সবার প্রিয় বাবু। চিত্রাঙ্কন-আর্ট যার জুড়ি মেলা ভার।
চারদিকে অনাচার অবিচার অন্যায়। প্রতিবাদ করতে চাই, চোখে মুখে বিপ্লবের নেশা। বিপ্লব ছাড়া মুক্তি নাই। সমাজতন্ত্র ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেই সময় প্রকাশ্য রাজনীতিতে সমঝোতা, দালালি আর নতজানু নেতৃত্ব আমাদের বিষিয়ে তোলে। সশস্ত্র বিপ্লব, শ্রেণি শত্রু, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া নানা কথায় আসক্ত হয়ে আন্ডার গ্রাউন্ডের রাজনীতি শুরু করি। আন্ডার গ্রাউন্ডে সবাই পরে আব্দুর রাজ্জাক বাবু ওরফে আর্ট বাবু নামে পরিচিত করে তোলে।
আজ মঙ্গলবার পাবনায় চরমপন্থীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষে আলাপকালে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল লাল পতাকা) আঞ্চলিক নেতা আর্ট বাবু এসব কথা বলেন।
আর্ট বাবু বলেন, ‘আমি অনেকবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সুযোগ দেওয়া হয়নি। এবার দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সে সুযোগ করে অনেক উপকার করেছেন। অন্ধকারের জীবন জীবন নয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। সব সময় মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জীবন চালানো কঠিন।’ তাই যারা আত্মসমর্পণ করেননি তাদের এই সুযোগ হাতছাড়া করা কোনোমতেই ঠিক হবে না বলে মনে করেন আর্ট বাবু।
‘সন্ত্রাসী পথ ছাড়ি স্বাভাবিক জীবন গড়ি’ এই স্লোগানে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রত্যাশায় দেশের ১৪টি জেলার চারটি নিষিদ্ধ সংগঠনের ৫৯৫ জন চরমপন্থী সদস্য আজ ৬৮টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছেন। বিকেলে পাবনার শহীদ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন স্টেডিয়ামে এক অনুষ্ঠানে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে এই আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীসহ পাবনা ও রাজশাহীর জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত এক সপ্তাহ ধরে পাবনা উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়।
মঙ্গলবার বিকেলে পাবনার শহীদ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন স্টেডিয়ামে আত্মসমর্পণ করেন আব্দুর রাজ্জাক বাবু ওরফে আর্ট বাবু। ছবি : এনটিভি
পুলিশ জানায়, অন্ধকারের পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ঘোষণা দিয়ে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ১৫ জেলার পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল লাল পতাকা), নিউ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও কাদামাটি নামের চারটি নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী সংগঠনের ৬১৪ জন সদস্য। এদের মধ্যে মঙ্গলবার ৫৯৫ জন আত্মসমর্পণ করে। অন্য ১৯ জন আইনি প্রক্রিয়ার পর আত্মসমর্পণ করবে বলে আশা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সূত্র জানায়, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রাজশাহী, বগুড়া, নড়াইল, রাজবাড়ী, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর জেলার সক্রিয় বিভিন্ন চরমপন্থী দলের সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। এ জন্য তাঁরা আত্মসমর্পণ করতে আগ্রহী। এসব দলের মধ্যে রয়েছে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), নিউ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও জয়পুরহাটের আঞ্চলিক দল কাদামাটি। আত্মসমর্পণকারীদের অনেকের বিরুদ্ধেই হত্যা, ডাকাতি, বিস্ফোরক ও অস্ত্র মামলা রয়েছে। তারা পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীও। আত্মসমর্পণ করলেও তাদের নিয়মিত মামলা চলবে বলে সূত্র জানায়।
পাবনার পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের চরমপন্থী দলগুলো নির্মূল না হলেও নেতৃত্বশূন্য ও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ ছাড়া, পরিবার বিচ্ছিন্ন ও অন্ধকার জগতের অপরাধ জীবন থেকে তারা সমাজে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পুলিশের সাহায্য চেয়েছে। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হবে।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, আত্মসমর্পণের পর তাদের আত্মনির্ভরশীল করতে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হবে। আবারও তারা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে নজরদারি থাকবে।
স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। তারা ধনীর সম্পদ গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলে এসব এলাকায় হত্যা, ডাকাতি ও লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করে।
আশির দশক থেকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে এসব এলাকার দুর্গম চরাঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য পরিণত করে। বর্তমানে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে চরমপন্থীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহজেই ধরা পড়ে যাচ্ছে।
পাবনা জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত চরমপন্থী দলগুলো অন্তকোন্দল ও পুলিশী অভিযানে নিহত হয়েছে ২৯৭ জন। মঙ্গলবার পাবনায় বাবলু প্রামাণিকের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি লাল পতাকা এবং ইউসুফ আলী ফকির ওরফে মিন্টু ফকিরের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির ১৩২ জন চরমপন্থী সদস্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেন।
আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ১৬ জন দলনেতা রয়েছেন। এঁরা হলেন, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর আনোয়ার হোসাইন খান (লাল পতাকা), পাবনার মোবারক হোসেন (লাল পতাকা), পাবনার মো. ইউসুফ আলী ফকির ওরফে মিন্টু ফকির (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি) পাবনা ও সিরাজগঞ্জের মো. মনসুর আলী (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি), রাজশাহীসহ জেলার নেতা আবু তালেব শেখ (লাল পতাকা), পাবনার মো. আব্দুল আলিম (লাল পতাকা), পাবনার বাবলু বেপারী (লাল পতাকা), রাজশাহী বিভাগের ইকবাল শেখ (লাল পতাকা), রাজশাহীর আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আর্ট বাবু (লাল পতাকা), রাজশাহীর আতাউর রহমান (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি), বগুড়ার মো. মহসিন আলী (লাল পতাকা), মো. মহসিন মল্লিক (লাল পতাকা), খুলনার ফারুক হোসেন মোল্লা (নিউ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি), সাতক্ষীরার আব্দুল্লাহ আল মামুন (নিউ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি), খুলনার লিপু মোল্লা (নিউ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি) ও জয়পুরহাটের রমজান আলী সরদার (কাদামাটি)।
এ উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকেলে পাবনার শহীদ অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাবনার পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। প্রধান বক্তা ছিলেন আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, গোলাম ফারুক প্রিন্স, শামসুল হক টুকু, মকবুল হোসেন, আহমেদ ফিরোজ কবির, ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ও নাদিরা ইয়াসমিন জলি, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি এম খুরশিদ হোসেন, পাবনার জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন, আত্মসমর্পণকারী পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল লাল পতাকা) আঞ্চলিক নেতা আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আর্ট বাবু, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির পাবনার আঞ্চলিক নেতা ইউসুফ আলী ফকির ওরফে মিন্টু ফকিরের স্ত্রী রত্না বেগম।