নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ভাইয়ের মামলা
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তাঁর ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে সোনগাজী থানায় মামলা করেছেন।
মামলায় অজ্ঞাতনামা বোরকাপরা চার নারীসহ মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা যৌন নিপীড়নের মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগকারী কয়েকজন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয়। মামলায় আসামি সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।
আজ সোমবার দুপুরে পুলিশ সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করেছে। তবে তাদের নামপরিচয় জানানো হয়নি।
তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, আটক তিনজনের মধ্যে মাদ্রাসার নিরাপত্তা প্রহরী মো. মোস্তফা ও অফিস সহকারী নুরুল আমিন রয়েছেন। এর আগে আটক মাদ্রাসার শিক্ষক আফসার উদ্দিন ও আলিম পরীক্ষার্থী আরিফকে ৫৪ ধারায় সোমবার সকালে আদালতে পাঠায় সোনগাজী থানা পুলিশ। বিকেলে সোনাগাজী উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরফ উদ্দিনের আদালত তাদের জেলহাজতে পাঠানোর আদেশ দেন।
সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আটক ব্যক্তিদের ৫৪ ধারায় আদালতে পাঠানো হলেও এ মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে। কারণ এদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে ফেনী জেলা প্রশাসনের নির্দেশে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
মাদ্রাসার তহবিল থেকে নুসরাতের চিকিৎসার জন্য অনুদানের দুই লাখ টাকার চেক আজ দুপুরে অতিরিক্ত জেলা প্রসাশক (ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) পি কে এম এনামুল করিম নুসরাতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি কে এম এনামুল করিম বলেন, ঘটনার পরের দিনই আমরা মাদ্রাসা গভর্নিং বডির একটি জরুরি সভা করেছিলাম। সেই সভায় আমরা গ্রেপ্তারের দিন থেকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করার এবং নুসরাতের চিকিৎসার খরচ জোগানোর জন্য মাদ্রাসার তরফ থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
এদিকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে জেলা প্রশাসক এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। আজ থেকে শুরু করে তিন কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছে।
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হলে পরীক্ষা ফেলে এগিয়ে আসেন আলিম পরীক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক। সোমবার সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। ছবি : এনটিভি
‘শিগগিরই আমরা কাজ শুরু করব। প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করার চেষ্টা করা হবে এবং আমরা কিছু সুপারিশও করব যাতে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা যায়।’ বলেন পি কে এম এনামুল করিম।
নুসরাত গায়ে আগুন নিয়ে ভবনের ছাদ থেকে নিচে নেমে আসার পর আলিম পরীক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিক আগুন নেভাতে এগিয়ে আসেন। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে সোমবার তিনি বলেন, ‘সেদিন আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। আমরা বৃত্ত ভরাট করছিলাম, এমন সময় হঠাৎ চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পারি। পরে দেখতে পাই একটি মেয়ের গায়ে আগুন জ্বলতেছে। সেখানে থাকা পুলিশের কনস্টেবল রাশেদ লাফ দিয়ে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। হাতের কাছে পানি না পেয়ে পাপোশ দিয়ে গায়ে বাড়ি মেরে আগুন নেভাতে চেষ্টা করতে থাকেন পুলিশ সদস্য রাশেদ। সঙ্গে সঙ্গে আমরা কয়েকজন নেমে আসি এবং সবাই মিলে মেয়েটার গায়ের আগুন নেভাই। এরপর আমার গায়ের পাঞ্জাবি মেয়েটার গায়ে পরায়ে দেই। পরে ডাক্তারখানায় নেওয়া হয়। এরপর আমার একজন শিক্ষক বলেন, তোমার পরীক্ষা। তুমি এখানে কী করতেছ, যাও পরীক্ষা দাও। তখন আমি চলে আসি।’
নুসরাত এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাওলানা এ কে এম মুসা মানিকের মেয়ে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
গত শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসা ভবনের ছাদে দুর্বৃত্তরা তাঁর গায়ে আগুন দেয়। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
পরিবারের অভিযোগ, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নুসরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তাঁদের মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোনাগাজী থানা পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।
এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় সিরাজউদ্দৌলার লোকজন। কিন্তু নুসরাত অপারগতা প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় আলিম পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে ভাই নোমান নুসরাতকে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। গত শনিবারও তিনি তাই করেন। একটু পরেই মাদ্রাসার তিনতলার ছাদে বোরকাপরা চারজন নুসরাতের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এদিকে গতকাল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আলিম পরীক্ষার জন্য মাদ্রাসা বন্ধ না রেখে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছিল। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর শনিবার বিকেলে প্রতিষ্ঠানের নোটিশ বোর্ডে আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাদ্রাসা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে হোস্টেলের ছাত্রদের হল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। তবে আলিম পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে মাদ্রাসা খোলা থাকবে।