চেয়ারে বসে পঙ্গু মঞ্জুরের শেষ আকুতি, ‘আমি মনে হয় আর বাঁচব না’
‘আমি তো বের হতে পারছি না। পঙ্গু মানুষ। আমি মনে হয় আর বাঁচব না। সবাই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি কোনো উপায় না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে আছি। সবাই আমার জন্য দোয়া করিস। তোরা ভালো থাকিস।’
অন্তিম মুহূর্তে জীবনের শেষ সময়ে ছোট ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশের সঙ্গে এ কথা বলছিলেন রাজধানী বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনে নিহত মঞ্জুর হাসান (৫০)।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। দুপুর আড়াইটার দিকে আবেগঘন কথা বলছিলেন মঞ্জুর হাসান। মঞ্জুর হাসানের বাড়ি নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া পূর্বপাড়ায়। তিনি মৃত মুনছুর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
নিহতের ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশ জানান, মঞ্জুর হাসান ছাত্রজীবন (১৯৮৭-৮৮ সাল) থেকে ঢাকায় থাকতেন। ছাত্রজীবন শেষে চাকরি শুরু করেন। এরপর সংসার। পরিবার নিয়ে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে বসবাস শুরু করেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরি করতেন। ঘটনার দিন মঞ্জুর হাসান ভবনের ২১তলায় কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে অবস্থায় করছিলেন। আগুন থেকে বাঁচতে সবাই যখন ছোটাছুটি করছিলেন তিনি কোনো উপায় না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে ছিলেন। আর জীবনের শেষ সময়টুকু স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। এক সময় ফোনে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। বার বার রিং হলেও অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না।
নিহতের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের লোকজন মঞ্জুর হাসানের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। নিহতের পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। তবে গত কয়েকদিন থেকে নিহতের ছোট ভাই শিমুল বাড়িতে আছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা জানতে পারেন তিনি।
নিহতের ছোট ভাই শিমুল হোসেন বলেন, চাকরিরত অবস্থায় ২০০০ সালে অফিসের সামনের রাস্তায় মঞ্জুর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এরপর থেকে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারতেন না। এক প্রকার পঙ্গু জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠানটি মঞ্জুরকে চাকরি থেকে বাদ দেয়নি। অফিসে যখন আগুন লাগে সবাই বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছিলেন। কিন্তু মঞ্জুর পঙ্গু হওয়ায় কিছু করতে পারেননি। অফিসে বসেই মোবাইল ফোনে আমাদের সাথে কথা বলছিলেন। আর দোয়া চেয়েছিলেন। তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘আমি তো বের হতে পারছি না। এখানে হয়তো আমার শেষ সময় যাবে।’ এক সময় তাঁর ফোনের সংযোগ কেটে যায়। এরপর ফোনে রিং হলেও রিসিভ হয়নি।
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে শেষ কথা হয় স্বজনদের সঙ্গে। উদ্ধারকর্মীরা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে সেখানে তাঁকে শনাক্ত করা হয়।
নিহতের চাচাতো ভাই সাবেক সেনা সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, যখন ঢাকায় থাকতাম নিয়মিত তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম। তাঁর অফিসে যেতাম। তাঁকে ধরে উঠ-বস করাতে হতো। যখন আগুন লাগার সংবাদ পেলাম তখন ধারণা করেছি হয়তো তিনি আর বের হতে পারবেন না।