জাহালমের ঘটনায় দুদকের দায় নির্ধারণ করবে আদালত
বিনা অপরাধে তিন বছর ধরে জেল খাটা টাঙ্গাইলের জাহালমের মামলার বিষয়ে আগামীকাল বুধবার আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবেদন দেখে ২৬ মামলায় ‘ভুল’ আসামি করার ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায় কতটুকু, তা নির্ণয় করবেন আদালত।
আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করার কথা থাকলেও পুরোপুরি তৈরি না হওয়ায় আজ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন,’ব্যাংকগুলোর দেওয়া কাগজপত্রের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত আমলে না নেওয়ার এখতিয়ারও দুদকের নেই। এ বিষয়ে ঘটনার একটি হলফনামা বুধবার আদালতে উপস্থাপন করা হবে।’
আইনজীবী বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, এই আইন বা তদন্তাধীন প্রণীত বিধি বা আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কাজের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, সেজন্য কমিশন, কোনো কমিশনার অথবা কমিশনের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা নেওয়া যাবে না।’
জাহালমের জামিন আদেশের পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি দুদকের আইনজীবী জাহালমের ঘটনার বিষয়ে ব্যাখ্যা দাখিলের জন্য সময় দেন হাইকোর্ট।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রথম অভিযোগপত্র দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের মতো একটি সরকারি ব্যাংক যখন আমাকে কিছু তথ্য-উপাত্ত পাঠাবে অবশ্যই সেটা আমাকে আমলে নিতে হবে। সেটার ভেলিডিটি (বৈধতা) নিয়ে প্রশ্ন ওঠানো দুদকের কোনো আইনগত এখতিয়ার নেই।’
খুরশীদ আলম খান আরো বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমেই তথ্য-উপাত্ত পেয়ে আমরা অভিযোগপত্র দাখিল করেছি। ব্যাংকের অফিশিয়ালসরাই তাকে (জাহালমকে) আইডেন্টিফাই করেছে। আমরা সে কথাগুলো এফিডেবিট ইন ফ্যাক্টসে (ঘটনার বর্ণনা বা ব্যাখ্যা হলফনামা আকারে দাখিল) দাখিল করেছি। আশা করি কাল শুনানি হবে।’
খুরশীদ আলম বলেন, ‘তার আগে ব্যাংকগুলোকে পক্ষভুক্ত করতে যে আবেদন, সেটি আগে শুনানি করতে চাইছি। কারণ এখানে ব্যাংক খুবই গুরুত্বপূর্ণ পারসন। আমরা চাই ব্যাংকগুলো এসে তাদের কথা বলুক।’
এ ঘটনায় দুদকের দায় নিয়েছে কি না? এমন প্রশ্নে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক না। আপনারা যেহেতু জিজ্ঞেস করছেন তাই বলছি, এ ঘটনায় দুদকের দায় কতটুকু, কিংবা অমার দায় আদৌ আছে কি না সেটা আদালত নির্ণয় করবেন। কারণ আমি পাবলিক ডকুমেন্টের ভিত্তিতে সরল বিশ্বাসে কাজ করেছি। সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩১ ধারায় বলা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, আমি যদি সরল বিশ্বাসে কাজ করে থাকি তাহলে দায়মুক্তি পাওয়া যাবে। এখানে আমার দায় কতটুকু সেটা নির্ণয় করবেন আদালত। এই কারণে আদালতকে আমরা বলেছি, এই ব্যাংকগুলোকে পক্ষভুক্ত করে ব্যাংকসহ আমাদের কথা একই সঙ্গে শোনেন।’
তাহলে কি জাহালমের ঘটনায় দুদক দায়মুক্তির পথ খুঁজছে কি না? জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই না, অবশ্যই না। আদালত যে আদেশ দিয়েছেন সে আদেশটা আমরা পালন করছি।’
জাহালমের ঘটনায় দুদকের ব্যাখ্যার বিষয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘জাহালম বিষয়ে একটি হলফনামা দেওয়ার জন্য আগামীকাল তারিখ ধার্য আছে। আজকে হলফনামাটা তৈরি করে আদালতের অনুমতি নিয়েছি, আদালত হলফনামার জন্য অনুমতি দিয়েছে। এখন হলফনামার কাজ চলছে, ১৩০ পাতার মতো। আমরা যেসব ডকুমেন্টের বেসিসে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দিয়েছি, সবকিছু এখানে আমরা দাখিল করেছি। খুব তাড়াহুড়া করে করেছি, কারণ সময় কম ছিল। আমরা আরো দেব। আপাতত মোটামুটি যেটা দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো আমরা দিয়েছি।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের রিপোর্টসহ যেসব রিপোর্টের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগপত্র দায়ের করেছে, তার সবকিছু দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা জজ পদ মর্যাদার একজনকে দিয়ে অনুসন্ধান করিয়েছে, তার কপিও দেওয়া হয়েছে।’
ব্যাংক পক্ষভূক্ত করারও বিষয়ে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) আমরা অনুমতি নিয়ে আরেকটা দরখাস্ত দাখিল করেছি পক্ষভূক্ত হওয়ার জন্য। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে মিস ম্যানেজমেন্ট হয়েছে। সোনালী ব্যাংকও বলেছে এই কথা। সেজন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংককে পক্ষভুক্ত করার জন্য একটা দরখাস্ত দিয়েছি। আশা করছি কাল শুনানি হবে। আদালতকে আমরা বলেছি কেন তাদের পক্ষভুক্ত করা প্রয়োজন। মোট ১৮টি ব্যাংক এখানে ইনভলব। কিন্তু আমরা আপাতত পাঁচটিকে করেছি। এই পাঁচটাকে করলেই আমরা মনে করি সত্য ঘটনাটা বের হয়ে আসবে।’
জানুয়ারিতে একটি দৈনিকে ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেন বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতিকে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এ ছাড়া রুলও জারি করেছেন। রুলে কারাগারে থাকা ‘ভুল’ আসামি জাহালমকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না এবং তাকে মুক্তির কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন।
পরে ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন।
ওই দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্যার, আমি জাহালম। আমি আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটির বয়স ৩০-৩২ বছরের বেশি না। পরনে লুঙ্গি আর শার্ট। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৬-এ বিচারকের উদ্দেশে তাকে বারবার বলতে দেখা যায়, ‘আমি আবু সালেক না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন এই জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।