স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরলেন তৃতীয় লিঙ্গের শাম্মী ও নিশাত
দৃপ্ত প্রত্যয়ে দেশে ফিরে এলেন শাম্মী ও নিশাত। উড়োজাহাজ দেশের মাটি স্পর্শ করতে না করতেই ওদের চোখ ভিজে আসে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতায়। বিমান থেকে অবতরণ করছিলেন আর ভাবছিলেন যেন আপেক্ষিক অর্থেই ভিন্ন এক জগৎ ছেড়ে আলোর জগতে অবতরণ করা জীবনের কথা। সেই আবেগে অশ্রু টলমলে চোখে কৃতজ্ঞতার সবটুকুই উজাড় করে দিচ্ছিলেন উত্তরণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমানকে।
কারণ, এই মানুষটিই তাঁদের মতো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের নায়ক। এক অর্থে যার পরিচয় দেবতুল্য মানুষ। যার ছোঁয়ায় আজ বদলে গেছে অচ্ছুত আর বঞ্চনার ‘হিজড়া জীবন’।
ভারতে মাসব্যাপী ‘উচ্চতর কেশসজ্জা প্রশিক্ষণ’ শেষে গত ২ মার্চ বিকেলে দেশে ফিরেছেন তৃতীয় লিঙ্গের শাম্মী ও নিশাত। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন দারুণ সব অভিজ্ঞতা, সমাজ বদলে দেওয়ার প্রত্যয় আর অসাধারণ সব স্বপ্ন।
কেশসজ্জা বিষয়ে তাঁরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিশ্বখ্যাত হেয়ার স্পেশালিস্ট জাভেদ হাবিব প্রতিষ্ঠিত হাবিব একাডেমি থেকে।
চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি উত্তরণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে উচ্চতর কেশসজ্জা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশে ছেড়েছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের দুই সদস্য শাম্মী ও নিশাত। কলকাতায় অবস্থিত জাভেদ হাবিব একাডেমিতে ৩০ দিনের ‘উচ্চতর কেশসজ্জা’বিষয়ক প্রশিক্ষণটি তাদের আরো বেশি আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে গড়ে তুলেছে—বলছিলেন শাম্মী ও নিশাত।
‘সব কৃতজ্ঞতা কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান স্যারের। আজ তাঁর অদম্য প্রয়াস আর চেষ্টাতেই আমরা আলোর পথে। আমাদের দেখাদেখি হিজড়াদের অনেকেই আজ স্বপ্ন দেখছে আত্মনির্ভরশীল জীবনের। আমরা শিখেছি, সমাজের মূল স্রোতে মিশে গিয়ে কী করে বাঁচতে হবে। সমাজে মর্যাদা আর মূল্যবোধ নিয়ে বাঁচতে হবে,’ আবেগে চোখ মোছেন শাম্মী।
দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ কেমন হলো?
‘এককথায় অসাধারণ। আমি অভিভূত, এককথায় উচ্ছ্বসিত,’ বলছিলেন নিশাত।
নিশাত বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে আশুলিয়ায় উত্তরণের প্রথম বিউটি পার্লারটি পরিচালনা আসছিলেন শাম্মী। সমাজের তাচ্ছিলের হিজড়া থেকে বিউটিশিয়ান পরিচয়ে তাঁর সাফল্য আমাকে আলোড়িত করে। যোগাযোগ করলাম। আমাকে সুযোগ-ও দেওয়া হলো। আজ আমি নিজেও গর্বিত। আমার জীবনের এই সাফল্যের প্রকৃত নায়ক আমাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মানুষ ডিআইজি হাবিবুর রহমান।’
‘এই প্রশিক্ষণ আমাদের প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী করেছে। আসলে কত বড় পরিসরে আমাদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে—এই প্রশিক্ষণ না পেলে বুঝতামই না,’ যোগ করেন শাম্মী।
বিশ্বখ্যাত হেয়ার স্পেশালিস্ট জাভেদ হাবিব প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। পাশে ডিআইজি হাবিবুর রহমান। পুরোনো ছবি
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের নজরে আসে, সাভারে বেদে সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশই এই কারবারে যুক্ত।
এই জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তাদের পুনর্বাসনে চাকরি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আলোচনায় আসেন তৎকালীন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান।
বেদে জনগোষ্ঠীকে সাড়ে চারশ বছরের গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তি দেন। বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের অন্ধকার জীবন থেকে আলোর ধারায় নিয়ে আসতে গুণীজনদের নিয়ে গঠন করেন উত্তরণ ফাউন্ডেশন। বেদেপাড়ায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, স্কুল, মসজিদ ও ঈদগাহ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কল্যাণমূলক নানা পদক্ষেপ প্রশংসা পায় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে।
সেই ধারাবাহিকতায় ‘হিজড়া’ বলে পরিচিতি সমাজের পিছিয়ে পড়া তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেন তাদের যথাযথ কর্মসংস্থানে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে সামাজিকভাবে সম্মানিত করেন হিজড়াদের। তাদের কর্মসংস্থানে ঢাকার সাভার, আশুলিয়া মানিকগঞ্জ সদরে ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘উত্তরণ বিউটি পার্লার’।
এ ছাড়া ঢাকার কামারপাড়া, গাইবান্ধার ডেভিড কোম্পানিপাড়ায় ও রাজবাড়ী সদরে তিনটি ডেইরি ফার্ম স্থাপন করে অর্ধশতাধিক হিজড়ার ভাগ্য বদলে দেন হাবিবুর রহমান।
অন্যদিকে ঢাকার মগবাজারে বুটিক হাউস ও বুটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মিনি গার্মেন্টস, উত্তরার রাজউক মার্কেটে টেইলার্স, তুরাগ থানা এলাকায় টেইলার্স ও ধামরাই বাজারে একটি বুটিক হাউস স্থাপনের মাধ্যমেও অর্ধশতাধিক হিজড়ার জীবনমান বদলে দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান।
উত্তরণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডিআইজি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মানুষ বেঁচে থাকে তাঁর কর্মে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে টেনে তোলা মানুষ হিসেবে আমাদেরই দায়িত্ব। কারণ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে এই মানুষদের কর্মসংস্থানের কোনো বিকল্প নেই।’
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হলে অচিরেই আরো অর্ধশতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পছন্দের সম্মানজনক পেশা আকঁড়ে ধরে নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।’
‘আমাদের প্রয়াসে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদল হচ্ছে। এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পরিচালিত রূপসজ্জার কেন্দ্রগুলোতে (বিউটি পার্লার) আগের চাইতে ভিড় বাড়ছে। মানুষ এটা বুঝতে পারছে, তারা অনেকে বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ। এই আত্মবিশ্বাসটা কিন্তু আমরাই তৈরি করেছি। ভারতের হাবিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বখ্যাত কেশ বিশেষজ্ঞ (হেয়ার স্পেশালিস্ট) জাভেদ হাবিবের সঙ্গে আমরা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। যার অধীনে প্রতিবছর উত্তরণ ফাউন্ডেশন মনোনীত তৃতীয় লিঙ্গের দুজন সদস্যকে কলকাতায় অবস্থিত জাভেদ হাবিব একাডেমিতে উচ্চতর কেশসজ্জাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’
‘গত ২ মার্চ শাম্মী ও নিশাত ফিরেছেন। নতুনরা স্বপ্ন দেখছেন উচ্চতর প্রশিক্ষণের। এভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিকমানের কেশসজ্জা বিশেষজ্ঞ তৈরি করছি,’ বলছিলেন হাবিবুর রহমান।
উত্তরণ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান শায়ক বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান এক অর্থে এই সময়ের সমাজ সংস্কারক। পেশাগত জীবনে একজন সফল পুলিশ কর্মকর্তা। কিন্তু পেশাগত গণ্ডির বাইরে তাঁর ভাবনাটা সব সময়ই অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করা। সেই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে পেরে আমি নিজেও গর্বিত।’
উত্তরণ ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী এম এম মাহবুব হাসান জানান, ২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেছে। তা সত্ত্বেও সমাজে তারা ছিলেন অবাঞ্ছিত ও অবহেলিত। মানুষ এখনো যথেষ্ট সচেতন নন। তাদের দেখা হয় ঘৃণার চোখে, অবজ্ঞার চোখে। ডিআইজি হাবিবুর রহমান তাদের অভিশপ্ত ও গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। ভালোবাসা আর সম্মান নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাদের পুনর্বাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন সফল এই মানুষগুলোই নিজেরা এক একজন নিজেদের গোষ্ঠীতে আইকন। তাদের আলোয় আলোকিত এই সমাজ, রাষ্ট্র দেশ। আমরা এই স্বপ্নটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।