‘রোহিঙ্গারাও তো খাবার পায়, আমাগো কেউ দেখে না’
‘ভাই, আমাগো দেশে আশ্রয় নিয়া রোহিঙ্গারাও তো খাবার পায়। তাদেরকে সরকার টাকা-পয়সা দিয়া সাহায্য করছে। আমাগোরে খাবার দেওয়া তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত কেউ দেখতেও আসে নাই। রাত থেইকাই বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বাচ্চাগুলারে নিয়া ভিজতেছি। কাপড়চোপড় বলতে কিছুই নাই। কোনোমতে জানটা নিয়া বাইর হইয়া আইছি।’
কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুরের ভাসানটেকে জাহাঙ্গীর বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে সব হারানো জামাল মিয়া (৫৫)।
কিশোরগঞ্জের জামাল মিয়া চার ছেলেমেয়ে নিয়ে পাঁচ বছর ধরে এ বস্তিতে বাস করে আসছিলেন। গতকাল রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে জামাল মিয়ার বাড়িসহ শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। জামাল মিয়ার মতো অনেক পরিবার সবকিছু হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন।
আগুন লাগার ব্যাপারে জানতে চাইলে জামাল মিয়া বলেন, ‘রাতে ঘুমে ছিলাম। হঠাৎ দেখি, চারপাশে আগুন আগুন চিৎকার। পরে বাচ্চাগো নিয়া পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিই। এর পরে কোনোমতে জানটা নিয়া বাইর হইয়া আইলাম। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। পোলাপাইনগো নিয়া মাঠে বইসা আছি। কোনো খাবার দিতে পারি নাই। ওরা কানতাছে। আমাগো অবস্থা রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ। রোহিঙ্গাদের তো সরকার টাকা দেয়, খাবার দেয়। কিন্তু আমাগো কেউ খবর নেয় না।’
কথা হয় ওই বস্তির খোরশেদা বেগমের সঙ্গে। রাস্তায় কাজ করেন তিনি। আগুন লাগার সময় ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাতে আগুন আগুন চিৎকারে জেগে দেখি দরজার কাছাকাছি আগুন। বাচ্চাগুলোরে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পেরেছি কোনোরকমে।’
খোরশেদা বেগম আরো বলেন, ‘ড্রামভর্তি চাল ছিল। টিভিসহ অন্য জিনিসপত্রসহ নগদ ২০ হাজার টাকার সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাবা পোলাপানগুলারে নিয়ে কী খাবো?’
সরেজমিনে সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরের ভাসানটেকে জাহাঙ্গীর বস্তির সব ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বস্তিতে বাস করা লোকজন পোড়া জিনিসপত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। নিজেদের শেষ সম্বল বলতে এখন পুড়ে যাওয়া বাঁশ আর কাঠ। নিজেদের পরনের জামা-কাপড় ছাড়া কিছুই নেই, সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
বস্তির আশপাশের রাস্তায় ছেলেমেয়ে নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন তাঁরা। আগুনের পাশাপাশি বৃষ্টির কারণে রাস্তায় কাদা জমে একাকার হয়ে আছে। বসার জায়গাও নেই। পরনের কাপড়চোপড় ছাড়া আর কিছুই নেই। বৃষ্টিতে এসব কাপড়চোপড়ও ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়চোপড় নিয়ে রাস্তায় অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকে শেষ সম্বল বলতে যা ছিল, তা হারিয়ে বিলাপ করছেন। আশপাশে শত শত উৎসুক জনতা দেখার জন্য ভিড় করছে।
এ ঘটনায় শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে বলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে ২১টি ইউনিট আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয় বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ডিউটি অফিসার ইন্সপেক্টর আতোয়ার রহমান।
আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হলো, তা নিশ্চিত করতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই সেখানে শতাধিক বাড়িঘর পুড়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই বস্তির বেশিরভাগ বাড়িঘর কাঁচা। টিন, বাঁশ ও কাঠের উপকরণ দিয়ে ঘর তৈরি হওয়ার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষও আগুন নেভাতে এগিয়ে আসেন। রাত ৪টার দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
ভাসানটেক থানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মিরপুর ১৪ নম্বরের এই বস্তিতে প্রায় এক হাজার ঘর আছে। এক বছর আগেও ওই বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক ঘর পুড়ে গিয়েছিল।