‘দুটি মাসুম বাচ্চাকে কী বুঝ দিমু’
নির্বাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে পাঁচ বছরের শিশু বিবি মরিয়ম সানিন এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে, মাকে দেখা যায় কি না। এভাবেই কিছুক্ষণ বাবার কোলে, কিছুক্ষণ মামার কোল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু কোথাও মায়ের দেখা পেল না।
এখন যদি মায়ের মরদেহ পাওয়া যায়—এ আশায় মর্গের সামনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক টিমের কাছে নিজের লালা দিয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য।
আজ শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে বাবার সঙ্গে মায়ের খোঁজে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে আসে ছোট্ট বিবি মরিয়ম সানিন। পাঁচ বছরের শিশুটি ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কী হয়েছে! সবাই বলছে, তার মা আর নেই। কিন্তু সে জানে—মা তো একটু বাড়ির নিচে গিয়েছিল। তারপর কোথায় গেল?
সানিনের পাঁচ মাস বয়সী ছোট্ট বোন বিবি ফাতেমা সারাক্ষণ কাঁদছে। অবুঝ শিশুটিও তার মাকে খুঁজছে।
পুরান ঢাকার চকবাজারে গত বুধবার রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সানিনের মা বিবি হালিমা বেগম শিলা নিখোঁজ রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিবি হালিমা শিলার লাশ খুঁজে পেতে তাঁর মেয়ে সানিনের ডিএনএর নমুনা নিয়েছেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতালে আসা হালিমার স্বামী জহিরুল হক সুমন কাঁদতে কাঁদতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থান থেকে ২০০ গজ দূরেই আমাদের বাসা। চকবাজারেই আমার দোকান রয়েছে। ঘটনার দিন (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে আমার বড় মেয়ে সানিন একটু অসুস্থ ছিল। তাই স্ত্রীকে বললাম, তুমি নিচে নেমে ওষুধের দোকানে যাও। আমি মসজিদে নামাজ পড়ে দুজন একসঙ্গে বাসায় উঠব। মোবাইলে কথা বলার পর সে (হালিমা) নিচে নেমে এসে ওষুধের দোকানে যায়। আমি দোকান থেকে বের হয়ে দেখি চকবাজারের মোড়ে ভয়াবহ আগুন। তাঁকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছি, ফোনে কল যায়নি। ভয়াবহ আগুনের কারণে সামনেও যেতে পারছিলাম না। দৌড়ে বাসায় গেলাম। দেখি শুধু বাচ্চা দুটা বাসায়। আমার স্ত্রী বাসায় নেই। এরপর থেকে আর আমার স্ত্রীকে পাচ্ছি না।’
মায়ের মরদেহ পাওয়ার আশায় ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আজ শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে মুখের লালা দেয় শিশু বিবি মরিয়ম সানিন। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
ডুকরে ডুকতে কান্নারত জহিরুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “ভাই, দুটি মাসুম বাচ্চাকে আমি কী বুঝ দিমু। একটি বাচ্চার বয়স পাঁচ মাস। তার নাম ফাতেমা। গত দুদিন বাচ্চাগুলো তাদের মাকে খুঁজছে। না দেখে কিছুক্ষণ পর পর কাঁদছে। আমি ওদের বুঝ দেওয়ার কোনো ভাষা পাচ্ছি না। ছোট বাচ্চা কিছুক্ষণ পর পর দুধ খেতে চায়, আমি কোলে নিলে আমার বুকে দুধের সন্ধান করে। আমার বাচ্চাকে কে দুধ খাওয়াবে? বড় মেয়ে সানিন শুধু তাকিয়ে থাকে। ও আমাকে বলে, ‘বাবা, মা ওষুধ কিনে আসেন না কেন?’ আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। ভাই, আমি জানি হালিমাকে (স্ত্রী) ফিরে পাব না? তবু একবার যদি বাচ্চাগুলো দেখতে, মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম!”
নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কেশারপাড়া এলাকায় গ্রামের বাড়ি জহিরুল হক সুমনের। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের স্থান থেকে ২০০ গজ দূরেই ভাড়া বাসায় থাকেন। স্ত্রী হালিমা বেগম শিলা তাঁর এক বোন ও দুই শিশু সন্তানকে বাসায় রেখে নিচে গিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। তিনি সেই যে গেছেন, আর ফেরেননি।
পরিবারের সদস্যদের ধারণা, নিচে ওষুধ কিনতে গিয়ে শিলা হয়তো ভয়াবহ আগুনের কবলে পড়েন। হয়তো তিনি আর নেই। শনাক্ত না হওয়া লাশের ভেতরে শিলা থাকতে পারেন এমনটা ভেবে ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছেন তাঁরা। ডিএনএ টেস্টের জন্য মেয়ের মুখের লালা ও স্বামী থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন চিকিৎসকরা।
চকবাজারের নন্দকুমার সড়কের চুড়িহাট্টায় বুধবার রাতে আগুন লাগে। এতে ৬৭ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশত।