জাহালমের জীবনের সময়গুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
‘নির্দোষ লোককে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা নই। এখানে একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। এ ঘটনায় দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) দায় এড়াতে পারে না। একটি নির্দোষ লোক দু্ই বছরের বেশি জেলে রয়েছে। তাঁর জীবনের সময়গুলো ফিরিয়ে দিতে পারবেন? সে বাইরে থাকলে পরিবারের জন্য আয় করত। এখন পরিবার তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপনারা (দুদক) এ ঘটনায় অপরাধী।’
কারাগারে থাকা ভুল আসামি টাঙ্গাইলের জাহালমের শুনানির একপর্যায়ে আদালত এসব কথা বলেন। আজ রোববার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মামলার শুনানিকালে দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে এসব কথা বলেন।
বেলা সাড়ে ১১টায় শুনানির শুরুতে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আদালতে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে জাহালমের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে এসব মামলায় বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হয়। তবে গত বছর দুদকের নজরে আসে জাহালম প্রকৃত আসামি আবু সালেক নন। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও বিষয়টি জানানো হয়। তখন দুদকের অধিকতর তদন্ত ওঠে আসে জাহালম নির্দোষ। আসল আবু সালেকের ঠিকানা খোঁজে বের করা হয়। তখন দুদকের পক্ষ থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়।’
এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘দুদকের ইনভেস্টিগেশন পুলিশের চেয়ে ভিন্ন। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের তদন্ত আসবে কেন?’ খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘যখনই ভুল বলে জেনেছি, তখনই আমরা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি।’
আদালত বলেন, ‘এটা কি ভুল না অন্য কিছু? পুলিশের তদন্তে ভুল থাকতে পারে। কিন্তু দুদক তাদের আইনানুযায়ী প্রপারলি তদন্ত করলে এ ধরনের ভুলের সুযোগ কোথায়?’
খুরশিদ আলম খান আদালতে বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। কিন্তু পাঁচ-ছয় মাস আগে আমরা জানতে পারি জাহালম আসল আসানি নন। তখন আমরা তাকে মামলা থেকে অব্যহতি নেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করি।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা ভুলভাবে শনাক্ত করল কিন্তু কমিশন কী করল? দুদক চেয়ারম্যান কীভাবে মামলার অনুমোদন দিলেন? আপনারা বিষয়টি ২৪ মে ২০১৮তে জেনেছেন অর্থাৎ ছয়-সাত মাস হয়ে গেল এত দিন কী করলেন? তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করেননি কেন? দুদকের ফলস ইনভেস্টিগেশনের সুযোগ কোথায়,দুদক যদি প্রোপারলি কাজ করে তাহলে এ দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা স্থায়ী রূপ নেবে। নইলে দেশ পাকিস্তান হতে বেশি সময় লাগবে না।’
আদালত আরো বলেন, ‘এখানে একটি সিন্ডিকেট আছে। এখানে কোনো জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছে কি না, এই জাহালমকে মিথ্যাভাবে মামলায় অভিযুক্ত করার পেছনে দায়ী কে? আপনার অফিসের কেউ আছে কি না, আমরা দেখতে চাই দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।’
শুনানির পুরোটা সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতকে বলতে থাকেন, ‘জাহালমের বিষয়টি যখনই আমাদের নজরে এসেছে তখনই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। মামলার এফআইআরে নাম ছিল না। কিন্তু তদন্তের পর আটজনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে দেওয়া অভিযোগপত্রে জাহালমকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় এবং ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাহালমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আদালত এই আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘নির্দোষ যখন আপনার বুঝতে পারলেন, তখন আপনারা কী করেছেন? একদিনের জন্যও আপনারা তাঁকে কারাগারে রাখতে পারেন না। কেন আপনারা তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করলেন না? তার কি আইনজীবী ছিল না? এ সময় দুদকের আইনজীবী বলেন, তার পক্ষে কোনো অইনজীবী ছিল না।
জবাবে আদালত বলেন, ‘তাঁর পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; সে যদি চাকরি করত তাহলে পরিবারটি হয়তো সুন্দরভাবে চলত। কিন্তু যে মূল আসামি তাকে বানালেন সাক্ষী। আর নিরপরাধ মানুষকে ধরে এনে বানালেন আসামি।’
দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘জাহালমকে সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে দুদকের কোনো আপত্তি থাকবে না। আপনারা জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আদেশ দিয়ে দেন। জামিনের দরকার নেই। সোনালী ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য পাওয়ার পর আমরা আবু সালেকের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করি। এরপর ২০১২ সালের ১০ এপ্রিল আব্দুল্লাহ্ আল জাহিদ মামলার অনুসন্ধান করেন। এরপর চার্জশিটে জাহালমের নাম উঠে আসে। টাঙ্গাইলের স্থানীয় দুই ইউপি চেয়ারম্যানরা জাহালমকে শনাক্ত করেন।’আদালত দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে একাধিকবার বলেন, ‘দুদক একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সুস্থ তদন্ত হলে জাহালমের বিষয়টি এ পর্যায়ে আসত না। দুদকের ফলস ইনভেস্টিগেশনের কোনো সুযোগ নেই। দুদককে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের অভ্যন্তরীণভাবে চিহ্নিত করেন। তাহলে আমাদের ইন্টারফেয়ার করার সুযোগ থাকবে না। যদি না হয় তাহলে কিন্তু আমরা করব।’
আদালত আরো বলেন, ‘অনেক মামলায় দেখেছি আপনারা কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের নামার আগেই তাকে একটি নোটিশ দিয়ে দেন। অথচ পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই। তাহলে কেন নোটিশ দিচ্ছেন? প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় একজন অপরাধী না হওয়া সত্ত্বেও জেল খাটতে হলো কেন? দুদককে স্বচ্ছ হতে হবে।’
শুনানির শেষ পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত কাশিমপুর কারাগারের উপ-কারা মহাপরিদর্শককে আদালত বলেন, ‘আপনারা আজই জাহালমকে রিলিজ করে দেবেন। দুদক এর খরচ দেবে।’
এরপর আদালত সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের করা সব মামলা থেকে নিরীহ জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আজই মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। চিঠি পাওয়ার পর দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে পাঁচ বছর আগে জাহালম বলেছিলেন,তিনি সালেক নন। বাংলায় লিখতে পারলেও ইংরেজিতে লিখতে জানেন না। কিন্তু নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমের কথা সেদিন দুদকের কেউ বিশ্বাস করেননি।
এরপর ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের এসব মামলায় জাহালম গ্রেপ্তার হন। তিনি জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন।
গত ৩০ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি শেষে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না,তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। একই সঙ্গে নিরীহ জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি,মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা,স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩ ফেব্রুয়ারি (আজ) সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত) , মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্রসচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন।